
বছরের শেষটা সাধারণত সিনেমা মুক্তির মৌসুম হিসেবেই ধরা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ঢালিউডেও এ সময়ে সপ্তাহে দুই থেকে তিনটি সিনেমা মুক্তি পেত। গত বছরের ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল আট সিনেমা, তার আগের বছরগুলোতে সংখ্যাটা ছিল আরও বেশি। সেখানে এবার সিনেমা মুক্তি নিয়ে নেই কোনো তোড়জোড়। বাজার পরিস্থিতি নাকি হলে সিনেমার সংকট, নাকি দর্শকের পরিবর্তিত অভ্যাস? হঠাৎ সিনেমা মুক্তি না পাওয়ার কারণ কি রাজনৈতিক? ঘুরেফিরে এসব প্রশ্নই সামনে আসছে।
বেশ কদিন আগের কথা। সে সময় আজাদ সিনেমা হলে চলছিল প্রয়াত নায়ক মান্নার তেজি সিনেমা। কথা হয় হলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, সিনেমার সংকটে তাঁরা দর্শক ধরে রাখতে আগের সিনেমা চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে সিনেমার সংকটে স্টার সিনেপ্লেক্সেও নেই বাংলা সিনেমা। কেউ কেউ সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া সাবা আবার চালাচ্ছেন, কোথাও চলছে ঈদে মুক্তি পাওয়া উৎসব সিনেমা।
প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির তথ্যমতে, ডিসেম্বরে এখন পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে একটিমাত্র সিনেমা—খিলাড়ি। বছর শেষ হচ্ছে ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ দিয়ে। আহমেদ হাসান পরিচালিত সিনেমাটি ২৬ ডিসেম্বর মুক্তির কথা রয়েছে। আরও জানা গেল, ডিসেম্বরে মুক্তির তালিকায় দুটি সিনেমা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এগুলোর প্রযোজক ও পরিচালক সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সিনেমার পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন সিনেমা মুক্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই। প্রথমত, এখন সিনেমা দর্শক দেখবে না। তা ছাড়া আমার সিনেমা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। এ সিনেমা দেখানোর মতো পরিবেশ পাচ্ছি না।’
ঈদে মুক্তি পাওয়া ইনসাফ সিনেমার প্রযোজক খোরশেদ আলম জানান, পরিবেশ নেই সত্য। তবে সিনেমার সংকট নেই। অনেক সিনেমা প্রস্তুত আছে। সেগুলোর প্রযোজকদের সঙ্গে কথাও হচ্ছে তাঁর। কিন্তু সিনেমাগুলোর প্রযোজকেরা এ মুহূর্তে সিনেমা মুক্তি দিতে চান না।
খোরশেদ বলেন, ‘এ বছরের দীর্ঘ একটা সময় ধরে নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সিনেমা মুক্তির জন্য অনুকূলে ছিল না। এ সময়ে হল আরও বন্ধ হয়েছে। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সবাই সিনেমা নিয়ে দোটানায় ছিলেন। এ ছাড়া এ সময় দর্শক হলে যাবে না। ব্যবসায়িকভাবেও কেউ ক্ষতির মুখোমুখি হতে চান না।’
গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে বাংলা সিনেমা এগিয়ে চলছিল। সেখানে হঠাৎ গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর সিনেমার সংখ্যা কমতে থাকে। তারপরও গত বছরের আগস্টের পর ১৮টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। সে সংখ্যা এবার কমে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছে মাল্টিপ্লেক্সগুলো।
স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, গত ঈদুল আজহার পর তাঁরা ব্যবসা করার মতো কোনো সিনেমাই পাননি। বছর শেষে সেই সংকট আরও বেড়েছে। যে কারণে একসঙ্গে হলিউডের চারটি সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে বলার মতো কোনো সিনেমা নেই। সর্বশেষ দেলুপি সিনেমাটি পেয়েছিলাম। ডিসেম্বর মাসজুড়েই কোনো সিনেমা পাইনি। এভাবে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। দর্শক এভাবে ধরে রাখা যায় না। আমরা সিনেমা চালিয়ে আয় করতে পারছি না।’
বছরের এই শেষ সময়ে অনেক প্রযোজক বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তি দিতেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রায়হান রাফীর ‘দামাল’ মুক্তি পায়। গত বছর শঙ্খ দাশগুপ্তর ‘প্রিয় মালতী’, আকরাম খানের ‘নকশীকাঁথার জমিন’সহ বেশ কিছু সিনেমা মুক্তি পায়।
নির্মাতা ও শিক্ষক মতিন রহমান বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে উৎসবমুখর থাকত সিনেমা অঙ্গন। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই নানা রকম গল্পের সিনেমা তৈরি করেছেন কিন্তু সেগুলো পরিস্থিতির কারণে মুক্তি দিচ্ছেন না। এটা নতুন করে ঢালিউডে একটা সংকট তৈরি করল। কারণ, সিনেমা মুক্তির ধারাবাহিকতা না থাকলে দর্শক একসময় আমাদের সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, শুধু ঈদের ছবির জন্যই অপেক্ষা করবে। যা সিনেমার জন্য সুফল বয়ে আনবে না।’