কবরী
কবরী

‘অ্যাই, খুব লেগেছে?’—প্রথম শুটিংয়েই চড় মেরে কবরীকে বলেছিলেন পরিচালক

বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরভাসমান এক নাম—কবরী। মিষ্টি মুখ, প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি আর স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ উপাধি। আজ ১৯ জুলাই, তাঁর জন্মদিন। ১৯৫০ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মেছিলেন তিনি। প্রকৃত নাম ছিল মিনা পাল।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিনেমায় অভিষেক হয় তাঁর, ছবির নাম ‘সুতরাং’। পরিচালক ছিলেন সুভাষ দত্ত। তিনিই ছিলেন ছবির নায়কও। গুলশান পার্কে কবরীর প্রথম শুটিং হয়েছিল ১৯৬৪ সালের একদিন। সেদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবরী লিখেছেন নিজের লেখা বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’-এ। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।
স্মৃতিচারণায় কবরী লিখেছেন, ‘চারদিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারাগাছ। শাড়ি পরে আমাকে পেয়ারাগাছের ডালে বসতে বলা হলো। শট নেওয়ার জন্য ক্যামেরা পায়ের ওপর ফোকাস করছে। হঠাৎ ডাল ভেঙে পড়লাম, শাড়ি জড়িয়ে একেবারে মাটিতে। হাঁটুর নিচে চামড়া ছিলে রক্ত ঝরছে। ব্যথা লাগলেও ভয়ে কাঁদতে পারছি না। ক্যামেরাম্যান কিউ এস জামান আর দত্তদা ছুটে এলেন।’

কবরী আরও লিখেছেন, ‘দত্তদা এক মুঠো ঘাস কচলিয়ে রক্তের জায়গায় লাগাতে চাইলে আমি কিছুতেই শাড়ি সরাতে দিচ্ছিলাম না। তখনই ঠাস করে চড় মেরে বসলেন। অপমান আর ব্যথায় ভ্যা করে কেঁদে উঠলাম। শুটিং শেষে সবাই এসে আদর করলেন। বললেন, “শটটা চমৎকার হয়েছে।”’

কবরী লিখেছেন, ‘দত্তদা এক মুঠো ঘাস কচলিয়ে রক্তের জায়গায় লাগাতে চাইলে আমি কিছুতেই শাড়ি সরাতে দিচ্ছিলাম না। তখনই ঠাস করে চড় মেরে বসলেন। অপমান আর ব্যথায় ভ্যা করে কেঁদে উঠলাম।’
‘অধিকার’ চলচ্চিত্রে কবরী

তবে এখানেই শেষ নয়। শুটিং শেষে দত্তদা এসে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘অ্যাই, খুব লেগেছে?’ সেই কণ্ঠে যেন স্নেহ ছিল, ছিল অপরাধবোধও। কবরীর অভিমানী চোখ ছলছল করে উঠেছিল। মাথা নেড়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, খুব লেগেছে।’ জবাবে সুভাষ দত্ত বলেছিলেন, ‘ধুর পাগলি! কাঁদতে হয় নাকি! কত ব্যথাই তো আমরা পাই, একটুও কাঁদি না। সিনেমায় অভিনয় করতে এসেছ, অনেক কষ্ট করতে হবে। তা না হলে নাম হবে কেমন করে?’
এই এক চড়ই যেন কবরীকে শিখিয়েছিল অভিনয়ের কঠিন পাঠ। সিনেমা যে শুধু গ্ল্যামার নয়, সেটি রক্ত, ঘাম, কষ্ট আর ত্যাগের মিলিত ফল—তা প্রথম দিনেই বুঝেছিলেন তিনি।

এরপর কবরী থেমে থাকেননি। ‘সুজন সখী’, ‘সারেং বউ’, ‘হীরামন’, ‘দেবদাস’, ‘রংবাজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বধূ বিদায়’—এমন অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।
কবরী শুধু অভিনেত্রী ছিলেন না, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও লেখিকা। সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, আজীবন সম্মাননাসহ বহু সম্মাননা।

‘সুজন সখী’, ‘সারেং বউ’, ‘হীরামন’, ‘দেবদাস’, ‘রংবাজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বধূ বিদায়’—এমন অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।
‘রংবাজ’ ছবিতে কবরী ও রাজ্জাক

২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল কবরী চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তবে দেশের নানা প্রান্তে তাঁর জন্মদিন ঘিরে হতো নানা আয়োজন। টেলিভিশনে চলত স্মৃতিচারণা, প্রকাশ পেত অপ্রকাশিত গল্প, গানের ফাঁকে ফাঁকে বাজত তাঁর মিষ্টি হাসির মুখচ্ছবি।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিনেমায় অভিষেক হয় তাঁর, ছবির নাম ‘সুতরাং’। পরিচালক ছিলেন সুভাষ দত্ত। তিনিই ছিলেন ছবির নায়কও। গুলশান পার্কে কবরীর প্রথম শুটিং হয়েছিল
বই পড়ে সময় কাটাতেন কবরী

তবে কবরী না থাকলেও তাঁর জন্মদিনকে ঘিরে আয়োজন থেমে থাকেনি। কবরী বেঁচে আছেন সিনেমায়। কবরীর জন্মের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করেছে চ্যানেল আই। জানা গেছে, ১৯ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত চলবে এ আয়োজন। কবরীর অভিনীত তিনটি চলচ্চিত্র—প্রথম দিন ‘মাসুদ রানা’, পরদিন ‘বধূ বিদায়’ এবং শেষ দিন ‘বিনিময়’ প্রচার করা হবে। প্রতিদিন থাকবে কবরী অভিনীত ছবির গান নিয়ে বিশেষ পরিবেশনা ‘এবং সিনেমার গান’। ২০ জুলাই বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে প্রচারিত হবে আবদুর রহমানের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় কবরীর সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘সাময়িকী’। পরদিন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে অভিনেত্রী কবরীর ৫০ বছরের অভিনয়জীবন নিয়ে চিত্রনায়িকা মৌসুমীর উপস্থাপনায় প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অভিনেত্রীর পঞ্চাশ বছর’।