তিন হাজারের বেশি গোরখোদক কিশোরগঞ্জের মনু মিয়া মারা গেছেন। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুর খবর ফেসবুকে জানিয়েছেন অভিনেতা খায়রুল বাসার।
ফেসবুক পোস্টে বাসার লিখেছেন, ‘মনু কাকা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এত দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিন দিন আগে উনি বাড়ি ফিরেছেন। বলছিলেন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ আছেন। উনার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা আল্লাহ কবুল করেছেন। সুস্থ থেকেই উনি আল্লাহর ডাকে ফিরতে চেয়েছিলেন, এই দোয়াও চাইতেন। হয়তো নিজ গ্রাম নিজের জন্মস্থান থেকেই আল্লাহ তাঁকে ডেকে নেবেন, এই চেয়েছেন আল্লাহ।’
বাসার আরও লেখেন, ‘তাঁর মহৎ কর্মের ফলস্বরূপ আল্লাহ নিশ্চয়ই উনাকে উনার স্বপ্নের ঘোড়া উপহার দেবেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। সবাই মনু কাকার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।’
কারও মৃত্যুসংবাদ কানে আসামাত্রই খুন্তি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোড়ায় করে ছুটে যেতেন কবরস্থানে। মানুষের অন্তিমযাত্রায় তিনি বাড়িয়ে দিতেন তাঁর আন্তরিক হাত। এভাবেই কবর খুঁড়েছেন ৫০ বছর ধরে। এ জন্য কখনো নেননি কোনো পারিশ্রমিক। কবর খুঁড়তে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে নিজের ধানিজমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে তিনি কিনেছিলেন একটি ঘোড়া। সম্প্রতি রোগে কাবু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ঘোড়াটির মৃতদেহ দেখতে পায় স্থানীয় লোকজন। মনু মিয়াকে নিয়ে প্রথম আলোতে ‘৩ হাজারের বেশি কবর খোঁড়া মনু মিয়া হাসপাতালের শয্যায়, ঘোড়াটি মেরে ফেলল দুর্বৃত্তরা’ প্রতিবেদন দেখে অভিনেতা খায়রুল বাসার ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ঘোড়া কিনে দিতে চাইলেও রাজি হননি মনু মিয়া।
বাসার তখন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন হাজারের বেশি কবর খুঁড়েছেন মনু মিয়া। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেছেন নিজের ঘোড়া। সেই ঘোড়াটিকে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলার কথা শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমরা একই অঞ্চলের ভাটির মানুষ। আমাদের আঞ্চলিক ভাষা এক। কথার একপর্যায়ে তাঁকে বলি, “একটি ঘোড়া আপনাকে কিনে দিতে চাই।” কিন্তু তিনি ঘোড়া নিতে চান না। কোনোভাবেই তাঁকে রাজি করাতে পারিনি; বরং তিনি বারবার এটাই জানিয়েছেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে সাতটা ঘোড়া কিনতে পারবেন।’
বাসারের নিজের উপলব্ধি, মনু মিয়ারাই সমাজের নায়ক। যাঁদের অন্তরের চোখ দিয়ে দেখা যায়, উপলব্ধি করা যায়। অভিনেতা বলেন, ‘এমন মানুষের কথা শুনলে জটিলতায় ভরা দুনিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে আলাদা দায় অনুভব করেন। যা আমাদের এই সমাজে সবার জন্য অনুসরণীয়। মনু মিয়াই আমাদের এক উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে উঠেছেন। মনু মিয়া নায়ক হতে চাননি। তাঁর মহৎ কাজ তাঁকে আমাদের নায়ক করে তুলেছে। এই দিশাহীন সমাজে তাঁর মতো খাঁটি সোনার মানুষের অভাব।’