Thank you for trying Sticky AMP!!

ছিনতাইকারীকে গান শুনিয়েছিলেন খুরশীদ আলম

খুরশীদ আলম। ছবি: রাসেল মাহমুদ
>

‘চুমকি চলেছে একা পথে’র মতো বহু জনপ্রিয় গানের শিল্পী খুরশীদ আলম। তাঁর শিল্পীজীবনের প্রাপ্তি অনেক। এখনো উচ্ছল। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর ৭৩তম জন্মদিন আজ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপনে অংশ নেন তিনি। জানান নিজের সংগীতজীবনের নানা গল্প।

একবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন শিল্পী খুরশীদ আলম। পড়বেন নাই-বা কেন! গাড়ি নেই তাঁর। বেশির ভাগ সময় হেঁটে চলাফেরা করেন। ছিনতাইকারীর ছিল সংগীতপ্রীতি। কোমরে অস্ত্র আছে, সেটা নিশ্চিত করে শিল্পীকে বলেছিলেন, আপনাকে এখানে মেরে রেখে গেলে একটা গাড়িও থেমে দেখতে আসবে না। আপনার একটা গান আমার অনেক ভাল্লাগে। দুই লাইন গেয়ে শোনাবেন? খুরশীদ আলম গান শুনিয়েছিলেন। তারপর তাঁকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিল সেই ছিনতাইকারী। গল্পটা অনেক জায়গায় বলেছেন খুরশীদ আলম। গতকাল চ্যানেল আই কার্যালয়ের লবিতে বসে আরও একবার বললেন।

তখন দুপুর গড়িয়েছে বিকেলের দিকে। জানতে চাইলাম, ‘খেয়েছেন?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন? দেশের বাড়ি কোথায়? ওহ্ খালিশপুর! জায়গাটা আমার অনেক চেনা। চাকরি করেছি অনেক দিন।’

৭৩তম জন্মদিন আপনার, সেটা মনে রেখে খাওয়াদাওয়া করছেন তো?
একদম না। খারাপ জিনিসগুলোই আমার বেশি পছন্দ। আমার ফেবারিট জিনিস ডিম। মগজ, সেটা গরু হোক, খাসি হোক বা মুরগির। আরও আছে, মোস্তাকিমের চাপ। সাদি ভাই একদিন ফোন করে বললেন, তুমি নাকি ছয়টা ডিম খাও? আমি বলেছি, যে বলেছে, সে কম বলেছে। মিনিমাম ১২টা, আজও ৪টা খেয়েছি। আসলে যে যেভাবে থাকতে চায়, সে সেভাবেই ভালো থাকে। আমি ব্যতিক্রম গানের জায়গায়। আমাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আইসক্রিম কেউ খাওয়াতে পারেনি। আমার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে। কেউ যদি এক গ্লাস পানি দিয়ে বলে, ভাই, এটা ফ্রিজের পানি, আমার গলা বসে যায়। সে জন্য পৃথিবীর সেরা আইসক্রিম কিংবা কোল্ড ড্রিংকস কেউ খাওয়াতে পারেনি। আমি মনে করি, হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। তাই আমি হাঁটি। হাতিরপুল থেকে কমলাপুর স্টেশনে হেঁটে যাই, টিকিট কিনে হেঁটে ফিরে আসি। আমার ক্লাসমেটদের অনেকে বিছানায় পড়ে আছে। কারও বুকে রিং, কারও পেসমেকার। গর্ব করছি না, আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন। বেশি ডিম খাই বলে ছোট মেয়ে একটু মাইন্ড করে। একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার মেয়েকে বললেন, যেহেতু ডিম ছাড়তেই পারছেন না, ডিমের সাদা অংশ খাওয়ান। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লালটায় সমস্যা কী? ওটাই তো বেশি টেস্টি। ডাক্তার বললেন, না না বয়স বাড়ছে। মেয়েকে বললাম, চলো আর একজনকে দেখাই। আরও কোয়ালিফায়েড একজনের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, আপনার বাবাকে শুধু লাল অংশটুকু খাওয়াবেন। মেয়েকে বললাম, দেখেছ? সবই খাওয়া যাবে। ডাবের শাঁস নাকি এ বয়সে হার্মফুল। আমি ওটাও খাই। তালের শাঁস খাই।

সংগীতে যে এলেন, কে আপনাকে পথ দেখালেন?
আমার সেজো চাচা আবু হায়দার সাজেদুর রহমান। রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। আমার দাদা কিছুতেই চাইতেন না যে ফ্যামিলিতে কেউ গান-বাজনা করুক। চাচা বিদ্রোহ করে এ লাইনে গেলেন। দাদা তাঁকে বোঝালেন, তুমি কি আমার ছেলে হয়ে থাকতে চাও? তাহলে গান-বাজনা কোরো না। সে জন্য তিনি গানকে প্রফেশন হিসেবে নেননি। গান করতেন এবং করাতেন। নাচ করতেন এবং করাতেন। সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের ওয়াইফ লায়লা হাসান তাঁর ছাত্রী। আমেরিকা ও ইন্ডিয়ায় তাঁর ছাত্রছাত্রী আছে এখনো।

তিনি তো ‘কুয়াশা’ ছদ্মনামে লিখতেনও?
হ্যাঁ। চাচা আমাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কেবল ম্যাট্রিক পাস করেছি তখন। তিনি বলেছিলেন, তিন ডব্লিউ থেকে দূরে থাকবে, ওয়েলথ, ওয়াইন ও ওমেন। কোনো চাচা তাঁর ভাতিজাকে এভাবে বলে কি না, আমার জানা নেই। আমাকে অনেকেই তাস খেলতে ডাকত। আমি বলতাম, ভাই এসব বুঝি না।

চাচার কাছ থেকেই আপনার রবীন্দ্রসংগীতে আসা?
রয় হাউস বলে একটা বাড়িতে একটা গার্লস স্কুল ছিল। প্রতি শুক্রবার চাচা সেখানে শেখাতেন। আমিও গান গাইতাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে ছেলেরা সেখানে আসত। আবৃত্তি, গল্প, কৌতুক, ভ্রমণকাহিনি বলতে চায়, তারা। স্কুল ব্রডকাস্টিং অনুষ্ঠান হতো একটা। সে সময় আমি রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম। তখন ঢাকার প্রত্যেক স্কুলে গান, ড্রয়িং ও পিটির জন্য আলাদা শিক্ষক ছিল। উর্দু ও সংস্কৃতি পড়ানোর শিক্ষক ছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে পরপর দুবার শিক্ষাসফরের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হই আমি। আধুনিক গানে প্রথম হই, পল্লিগীতিতে দ্বিতীয়। তখনো বাংলাদেশের কোনো সিনেমার গান জানতাম না। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছি। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রবীন্দ্রসংগীত ব্যান করলে পড়ে গেলাম বিপদে। না বেতারে গাইতে পারি, না মঞ্চে গাইতে পারি। রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী হতে না পারি, শিল্পী হয়েছি। আমি মনে করি, একজন মানুষ চেষ্টা করলে তার টার্গেটের পুরোটা না পারুক, ৭৫ শতাংশ অর্জন করতে পারে।

রবীন্দ্রসংগীত থেকে আধুনিক গানের শিল্পী হলেন কীভাবে?
অত্যন্ত গুণী ও জনপ্রিয় শিল্পী আবদুল জব্বার সাহেব একদিন বললেন, ছোট ভাই, কাল একটা ফাংশনে যাব করটিয়ায়। তুমি যাবে? ভাবলাম, দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী বলেছে, যাব না কেন! এখন অনেকে অনেক হিসাব করবে। আমি যেতে বললে এখনকার শিল্পীদের অনেকে হয়তো আগে চিন্তা করবে, খুরশীদ আলম স্যার বা ভাইয়ের সঙ্গে যদি যাই, আমার রিটার্নটা কী? হোয়াট ইজ মাই বেনিফিট। আমি সেদিন করোটিয়ায় প্রায় ১০ হাজার লোকের সামনে হিন্দি গান করেছিলাম। রফি সাহেবের গান। স্কুলে যখন পড়তাম, তখন টিফিন পিরিয়ড ছিল ২০ মিনিট। পাশেই একটা পানের দোকানে গিয়ে সেই সময়ে হিন্দি গান শুনতাম। পরপর দুই দিন না গেলে লোকটা আমার খোঁজ করত। ওই গান শোনাই আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছে। মিউজিক বেজে ওঠার সঙ্গে বলতে পারতাম এই গান সন্ধ্যা মুখার্জি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে, কিশোর কুমার না মোহাম্মদ রফির।

খুরশীদ আলম। ছবি: রাসেল মাহমুদ


প্রথম গাইলেন কবে?
১৯৬৬ সালে বেতারে অডিশন দিই। অডিশন নেন গুণী সুরকার রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ আবদুল আহাদ সাহেব। শান্তিনিকেতন থেকে পাস করা। ছিলেন সমর দাস, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পিলার তিনি। আর ফেরদৌসী আপা। গান শোনার পর সমর দাস বললেন, গলা খুব ভালো, কিন্তু তুমি একজনকে নকল করো। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ওই শিল্পী যত দিন আছে, তোমার গান কেউ শুনবে না। সবাই বলবে, খুরশিদ আলম গান গায় অমুক শিল্পীর মতো। সেদিন তাঁরা বললেন, গলা খুব ভালো। পাস-ফেল বললেন না। সমর দাস বললেন, কোথায় থাকো? বললাম কাজী আলাউদ্দিন রোড। তিনি লক্ষ্মীবাজার থাকতেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় তাঁর বাসায় যেতে বললেন। বললেন, হাফ অ্যান আওয়ার আমি তোমাকে শেখাব। তিনি পিয়ানোতে ‘সা’ ধরে থাকতেন। এখনকার ছেলেপেলেকে ওভাবে করতে বললে টিচারকে পেটাবে। প্রথমে ৫ সেকেন্ডে, পরে ১০, ১৫, ২০ সেকেন্ড। করতে করতে ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৫, ১০ মিনিট করে ধরে রাখতে লাগলেন। গান শেখাতেন না, সা রে গা মা পা ধা নি সা শেখাতেন। একদিন বললেন, যা, দশটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে গাবি। সবার থেকে তোর গলা আলাদা। সমরদা ইজ নট মাই রিলেটিভ। দেওয়া-নেওয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোনো টাকা নিতেন না। বরং আমি ওনার বাসায় পুড়ি-ভাজি খেতাম। ওনার বাবা বলতেন, ছেলেটাকে মেরে ফেলবে? তিনি বলতেন, মানুষ করছি।

খুরশিদ আলমের সঙ্গে গল্প চলছে। একের পর এক নানা বয়সী লোক পার হয়ে যাচ্ছেন। খুরশিদ আলমের চেনা-জানা যাঁরা, উঠে দাঁড়িয়ে নিজেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন। কুশল জিজ্ঞেস করছিলেন। জোরে জোরে হেসে কাউকে সম্বোধন করছিলেন স্যার, কাউকে ভাইয়া আবার কাউকে মাম্মা। ফিরে এসে বসছিলেন আগের জায়গায়। যেখানে থমকে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আবারও শুরু করছিলেন গল্প।

প্রথম গান করলাম ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ বেতারে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আমার দুটি গান আজাদ রহমান করেছিলেন। একটির গীতিকার কবি সিরাজুল ইসলাম। সুরকার আজাদ রহমান, ‘তোমার হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম/ থাকব তোমারই আমি কথা দিলাম’ (গেয়ে শোনালেন)। আরেকটি জেবুন্নেসা জামান লেখেন, সুর করেন আজাদ রহমান, ‘চঞ্চল দুনয়নে বলো না কি খুঁজছ/ চম্পা-না করবী-না পলাশের গুচ্ছ’ (গেয়ে শোনালেন)। প্রথম গানটি অল ওভার পাকিস্তান ডিস্ক সেল হতো। নূরজাহান, মেহেদি হাসান, রুনা লায়লা, ফিরোজা বেগম, ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা, শাহনাজ রহমতউল্লাহদের সঙ্গে...আমাকে একটা জায়গায় দাঁড় করানোর রাস্তা করে দেয় গানটা। ১৯৬৯ সালে আজাদ রহমান সাহেব একটা চলচ্চিত্র পান সংগীত পরিচালক হিসেবে। পরিচালক ছিলেন বাবুল চৌধুরী, প্রযোজক ছিলেন ইফতেখার রহমান। মেইন সিঙ্গার ছিলেন সোহরাব ভাই। আমরা তিনজন দোহার ধরতাম। আমার গলাটা ভালো লাগে তাঁদের। রাজ্জাক সাহেবের লিপে একটা সলো গান দরকার ছিল। বেশ কয়েক দিন ধরে সেই গান চেষ্টা করলাম। তখন গানের রিহার্সাল বেশ ভালো হতো। বাংলামোটরে একটা বাড়িতে রিহার্সাল হতো। ফার্মগেটে একটা স্টুডিও ছিল। রেকর্ডিং করতে গেলে একজন বলল, এই ছেলেকে দিয়ে গাওয়ালে গান সুপার ফ্লপ হবে। শিল্পী চেঞ্জ করেন। তখন আজাদ রহমান সাহেব যেটা করলেন, রক্ত দিয়ে আমি সেই ঋণ শোধ করতে পারব না। তিনি বললেন, যদি আমাকে সুরকার হিসেবে রাখেন, তাহলে খুরশিদ আলমকে শিল্পী হিসেবে রাখতে হবে।

রবিন ঘোষ বলে এক সুরকার ছিলেন। ‘পিচ ঢালা পথ’ নামে একটি ছবি করেছিলেন। ইস্কাটনে থাকতেন। একটা ছবি ভালো করার পেছনে সিনিয়রদের কত অবদান থাকে তার প্রমাণ তিনি। চাইলে নিজের তিন নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট পাঠাতে পারতেন যেন আমাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি নিজে আমার কাছে এলেন। ‘চিত্রালি’র সম্পাদককে নিয়ে আমার বাসায় দুই দিন গিয়ে আমাকে পাননি। তৃতীয় দিন আমাকে যেতে বললেন। তখন আমাকে ‘পাগল পাগল দুনিয়ায় মানুষ চেনা দায়’ গানটি শিখতে দিলেন। ভাত খাওয়ালেন, গল্প করলেন। চা খাওয়ালেন। আবার রিহার্সাল করালেন। আমি তৃতীয় গান যেটা গাই, সেটা সত্যদার। সত্যদা এমনভাবে গানের সুর করতেন, যে গান সম্পর্কে জানে না, সেও গাইতে পারত, যে গাইতে পারে সেও পারত। ইজি সুর করতেন। নায়ক জাফর ইকবালের লিপে আমার একটি গান হয়। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার সাহেব, গানটা ছিল ‘ডিম মারো ডিম মারো/ যত পারো জোরে মারো/ আমি ভেজে ভেজে খাব/ খেয়ে খেয়ে তাগড়া হব/ তাগড়া হয়ে আগ্রা যাব’। সত্যদা যত দিন জীবিত ছিলেন...আমি গান করেছি।

প্রচুর গেয়েছেন। কতগুলো ছবি, কতগুলো গান, কতজন শিল্পীর সঙ্গে গেয়েছেন, মনে আছে আপনার?
২০০২ পর্যন্ত ৪২৫টি ছবিতে গান করেছি। প্রায় সব নায়ক আমার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন। আমার গানে সবচেয়ে বেশি লিপ রাজ্জাক, ওয়াসিম, মাহমুদ কলি, আলমগীর সাহেব, জাভেদ সাহেব। দেশের যত ফিমেল আর্টিস্ট আছে...শেষ কনক চাঁপা, বেবি নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, রুনা, সাবিনা, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, জুলিয়া রহমান, মৌসুমী কবির, শাম্মী আখতার, শাকিলা জাফর এদের সঙ্গে আমার চলচ্চিত্রে গাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের থেকেও অনেক শিখেছি। মাইকে কীভাবে থ্রোয়িং করতে হয়, সুরকারেরাও শেখাতেন, শিল্পীরাও। টাকা-পয়সা কী ইনকাম করেছি, সেটা ব্যাপার না। সিনসিয়ারলি কাজ করলাম কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন তো দেখি টাকা-পয়সা কত আসছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অগ্রজ যাঁরা ছিলেন, খন্দকার ফারুক আহমেদ, মাহমুদুন্নবী সাহেব, এম এ হামিদ, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকি সাহেব, বশীর রহমান, আবদুর রউফ সাহেব, সৈয়দ আব্দুল হাদী, একজনের নামতো কেউ নেয়ই না, নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাই, এঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। এঁরা ডিভোটেড ছিলেন গানের প্রতি। হাদী ভাই শিক্ষকতা করতেন, আনোয়ার ভাই ব্যাংকে ছিলেন।

খুরশীদ আলম। ছবি: রাসেল মাহমুদ


আর সুরকারেরা?
সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি আজাদ রহমান ও সত্য সাহার সঙ্গে। বেতারে অনেক গান করেছি। বহু কমার্শিয়াল গান করা হয়েছে। খন্দকার নুরুল আলম সাহবের সুরে, সমরদা, আহাদ ভাই, এস এম রফিক সাহেবের সুরে, দেবুদা, আনোয়ার পারভেজসহ বহু সুরকারের সুরে গেয়েছি। মনে পড়ে, আলী হোসেন সাহেব যতক্ষণ স্যাটিসফাইড না হতেন, কাজ করাতেন। আলম খানের সুর করা যে গানই করেছি, হিট। সুরকার রবিন ঘোষ তো রিহার্সাল দেখেই আমাকে সিলেক্ট করেছিলেন। আজাদ রহমান সাহেব আমাকে যতটা দিতে পেরেছেন, দিয়েছেন। আমি যতটা পেরেছি, নিয়েছি। আজও বলেছেন, গানের জন্য খুরশিদ যতটা সময় দিয়েছেন, আর কেউ দেয়নি। মাত্র দুজনের সুরে সিনেমায় গাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। খান আতা ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আতা ভাইয়ের সুরে বেতারে গেয়েছি।

এখনকার সংগীত প্রজন্মের কথা বলুন। তারা কেমন?
দে আর ট্যালেন্টেড, অত্যন্ত ফাস্ট। প্রচুর জানে, অনেক কিছু তাড়াতাড়ি ক্যাচ করতে পারে। সমস্যা একটাই, তাঁদের কোনো গার্জিয়ান নেই। আমরা যখন গাইতাম, ১০-১২ জন লোক সামনে বসা থাকত। তাঁরা বলতেন, তাল কেটেছে, উচ্চারণ ঠিক হয়নি, উল্টো গেয়েছ। এখন এসব নেই। এখন আমিই গীতিকার, আমিই কম্পোজার। কাউকে ছোট করছি না, একটা লোকের পক্ষে একাই সবকিছু করা সম্ভব নয়। যদি কেউ হয়, বলতে হবে সে মহাপুরুষ। সে হিউম্যান বিং না। গান-বাজনা চর্চার ব্যাপার, গুরুমুখী বিদ্যা। যে যত শিখবে, সে তত টিকবে। যে যত শিখবে, সে তত জিতবে। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। শিখবে না তো ফাঁকিতে পড়বে। এখন যারা দর্শক-শ্রোতা, তারা অনেক অগ্রসর। প্রযুক্তি অনেক ডেভেলপ হয়েছে। মানুষ এখন অনেক খবর রাখে। আমার বাড়িতে ১৯২টি চ্যানেল চলে। গান-বাজনা একটা পবিত্র জিনিস। যার যার জায়গায় সিনসিয়ারলি কাজ করলে পারবে। গার্জিয়ান থাকতে হবে। আমার থেকে কেউ বেশি বোঝে না—এমন মানসিকতা ছাড়তে হবে।

আপনার গানে সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন চিত্রনায়ক রাজ্জাক। তাঁর কথা বলুন।
প্রথম ছবিটায় কেউ আমাকে শিল্পী হিসেবে মানতেই পারছিল না। আজাদ রহমান বেঁকে বসার পর রাজ্জাক সাহেব বলেন, কাম টু মাই হাউস। কষ্ট করে যে লোক ওপরে ওঠে, সে অন্যের কষ্ট বোঝে। রাজ্জাক সাহেব কীভাবে রাগে, কথা বলার ঢংটা কেমন, হাসলে কীভাবে হাসেন, রোমান্টিক হলে কীভাবে কথা বলেন, আমাকে এসব শেখালেন। তারপর বললেন, আমি তোমার গানে লিপসিং করব। এটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। গীতিকার আমার চাচা, সুরকার আজাদ রহমান, গাইলাম ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ (গেয়ে শোনান)। একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো।

রাজ্জাক ভাইয়ের মতো মানুষ হয় না। পরিপূর্ণ মানুষ। আমার জন্মদিনে সব সময় উইশ করতেন। আমি নিয়মিত তার বাড়িতে যেতাম। একটা লোক এমনিই নায়করাজ হয় না। আহমদ জামান চৌধুরী সাহেব তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘নায়করাজ’। কিন্তু সেটা ধরে রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, যত দিন জীবিত ছিলেন, সবাইকে দিয়ে গেছেন, কারও থেকে কিছু নেননি। আমি রাজ্জাক ভাইয়ের লাশ দেখিনি। চেয়েছি, তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখটাই যেন আমার স্মৃতিতে থাকে।

যা গেয়েছেন, প্রায় সবই হিট। কেমন উপভোগ করলেন?
আমি একক প্রচেষ্টায় খুরশিদ আলম হইনি। আমার শিক্ষকেরা, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী, টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, দর্শক—সবাই মিলেই আমাকে তৈরি করেছে। টাকা-পয়সা নেই, বাড়ি-গাড়ি নেই তাতে আফসোস নেই। মেয়েরা লেখাপড়া করেছে, বিয়ে দিয়েছি। তিনবেলা খেতে পারছি, এতেই আমি খুশি। শিল্পী হতে চেয়েছিলাম, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হতে পারলাম না বটে, আধুনিক গানের শিল্পী হয়েছি। এতেই আমি খুশি। আমার আক্ষেপ নেই।