
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ‘আমি জুলাইয়ের গল্প বলব বন্ধু’ শিরোনামে নতুন গান প্রকাশ করেছেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। গত বুধবার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মকফুল হোসেন
‘আমি জুলাইয়ের গল্প বলব বন্ধু’ কোন তাড়না থেকে করলেন?
সায়ান: যখন যেটা ঘটতে থাকে, সেটা নিয়ে মনের মধ্যে ভাবনাচিন্তা, গান-কবিতা আসে। সেটা হয়তো তখনই প্রকাশ করা হয় না; কিন্তু এটা আমার বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া। জুলাইয়ের অর্জন, সেটাকে কেন্দ্র করে অনেক কথাবার্তা হয়, কোথাও কোথাও হতাশাও আছে। সবকিছুর পরও এক বছর আগে এই মাটির বুকে কতগুলো বাচ্চা ছিল, অনেক মানুষ ছিলেন। মাটিতে বাচ্চাগুলোর রক্ত মিশে গেছে। এটাকে অস্বীকার করা, খাটো করা, মানতে না পারাটা আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। নিশ্চয়ই জুলাইকে অনেকে বিক্রি করছেন। নিশ্চয়ই জুলাই নিয়ে অনেকে অহংকারী হয়ে উঠেছেন। (তারপরও) জুলাই আমাদের বাংলাদেশের মাটির গল্প।
আপনি কোনো গণ-অভ্যুত্থানকে বাদ দিতে পারবেন না। আপনি উনসত্তর, নব্বইকে বাদ দিতে পারবেন না। এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। সেই তাড়না থেকে মনে হলো, আমি আমার জুলাইয়ের গল্প বলব। একটা গানের পরিসর আসলে ছোট। অনেক কিছুই ধরানো যায়নি। তবু একটা প্রতীকী গল্প বলতে চাওয়ার অসফল ফল হচ্ছে এই গান।
নিশ্চয়ই জুলাইকে অনেকে বিক্রি করছেন। নিশ্চয়ই জুলাই নিয়ে অনেকে অহংকারী হয়ে উঠেছেন।ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
আমরা চেতনা আর বন্দনার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
গানটিতে আপনি বলছেন ‘আমরা জুলাই বিক্রি করি না’, কোন পটভূমিতে প্রসঙ্গটা গানে এল?
সায়ান: আমরা চেতনা আর বন্দনার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। জুলাইয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যাঁর যাঁর জায়গা থেকে অংশগ্রহণ করেছেন। সেই জায়গাকে কেন্দ্র করে যেকোনো কথা প্রসঙ্গে জুলাইয়ের চেতনাকে বিক্রির কথা উঠছে। জুলাই নিয়ে অনেক ন্যায্য কথা, ন্যায্য কতগুলো দায়িত্ব রয়েছে; সেই জায়গার কথা মানুষ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
আমরা অতীতে দেখেছি, আমরা একটা ন্যায্য প্রশ্ন করলাম, সেই জায়গায় ক্ষমতাসীনেরা বলেছেন, ‘আমরা যা করছি, তা-ই ঠিক। আমরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি।’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি যেমন ৫০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অনেকাংশে বিক্রি করেছে, সে রকম করে জুলাইকে বিক্রি করার একধরনের মানসিকতা আমি দেখেছি। জুলাইকে বিক্রি হতে দেব না। আমরা চেতনা ব্যবসায়ীদের হাতে মার খাওয়া জনতা, আমরা তাদের চিনি। কখন কে এটা (জুলাই) বিক্রি করতে যাচ্ছে, সেটা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখে পড়ে।
এত দিন ধরে এত চেতনার ভার, এত চেতনা বিক্রির গল্প শুনেছি, সেটা আমাদের কানে লেগে আছে। একই গল্প যদি কোনো পক্ষ, গোষ্ঠী বা কিছু মানুষ করতে চান, সেটা ব্যক্তিগত জায়গা থেকে প্রতিরোধ করব। আর সমাজের জায়গা থেকে ভাবনাটা ছড়ানোর চেষ্টা করব। জুলাইয়ে অংশ নেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব ছিল, তাই বলে বাড়াবাড়ি কৃতিত্ব দাবি করা, মহৎ ভূমিকায় চলে যাওয়া অসমর্থনযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য। আপনার সন্তানের জন্য যা-ই করেন না কেন, সেটা কখনোই বাড়তি নয়; তেমনি একটা দেশের জন্য যা-ই করেন না কেন, সেটা কখনোই মারাত্মক বাড়তি কিছু নয়।
জুলাই কার?
সায়ান: অ্যাবসলিউটলি জনতার। অ্যাবসলিউটলি বাংলাদেশের সব মানুষের। যাঁরা গণতন্ত্রমনা মানুষ, যাঁরা অত্যাচার নিতে পারছিলেন না; যাঁদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। পিঠ এতটাই ঠেকে গিয়েছিল যে মৃত্যুকে আর পরোয়া করেননি। বেঁচে থাকার জন্য চুপ ছিলেন। তারপর দেখা গেল, খোলা বুকের ছেলেগুলোকে পুলিশ গুলি করে মারছে—সেই দৃশ্য বাংলাদেশের প্রতিটি কোণঠাসা প্রাণে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই জায়গা থেকে জুলাই ‘জুলাই’ হয়ে উঠল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী ছিল?
সায়ান: আশা-প্রত্যাশা নিয়ে অনেক পরে চিন্তা করেছি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, এটা নিয়ে ৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত ভাবার মতো অবকাশ ছিল না। জানতাম না, বেঁচে ফিরব কি না। আমি একা নই, লাখ লাখ মানুষ জানতেন না, পরদিনটা দেখবেন কি না।
আমার একটাই প্রত্যাশা ছিল, এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে হবে। পতনের পর শোক কাটাতে অনেক সময় লাগল। এখনো প্রতিদিনের অসংখ্য ঘটনা আমাদের আহত করে, হতাশ করে, কষ্ট দেয়। মনে হয়, আরও কত বড় লড়াই আমাদের লড়তে হবে। আমাদের বিচারে ফিরতে হবে, নির্বাচনে ফিরতে হবে। আমাদের শত্রু অনেক, এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
সাধারণ জনতা এখনো কোণঠাসা; কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে চৈতন্যের উদ্ভাস ঘটেছে, তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। এই জায়গাকে ইগনোর করতে পারবেন না। বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, মব হচ্ছে, তবে চোখ এড়াচ্ছে না কিছুই। আমরা গন্ডগোলের মধ্যে আছি, কিন্তু কিছুতেই আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কী হবে আমরা জানি না, সবাই মিলে যেটাকে ঠেকিয়ে দিতে পারব, সেটাই হবে। অনেক পক্ষ আছে, অনেক রকমের অভিযোগ, হতাশা আছে; কিন্তু দিন শেষে এটা আমাদের জনতার নতুন বাংলাদেশ, এখানে জনতাও একটা পক্ষ হিসেবে নিজেকে দেখেন। সেটা ছিল না আগে। এটা মানতে হবে।
গানেও আপনি বলছেন, লড়াইটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। প্রয়োজনে আবারও মাঠে নামবেন। বিষয়টি আসলে কী?
সায়ান: মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক বছর অনেক ধরনের অস্থিরতা ছিল; অনেক ধরনের দুঃখ-কষ্ট, ন্যায়-অন্যায় ছিল। অস্থিরতার মধ্যেও মনে করেন কেউ একজন এসে বলল, মুক্তিযুদ্ধ ভুল ছিল; এটা আমি কোনো দিন মানব না, স্বীকার করব না। তার মানে কী? মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরিচয়ের গল্প। স্বাধীনতাসংগ্রাম একবারই হয়, সেখানে আমরা জিতেছি। এরপর প্রত্যেকটা মানুষের হাজার হাজার সমস্যা, সেগুলো তো চলতে থাকে। সেখানে জনতাও একটা পক্ষ। জনতার বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। লড়াই কখনো শেষ হয় না।
সে হিসেবে বলব, একাত্তরের ধারাবাহিকতায় নব্বই আসে, একাত্তরের ধারাবাহিকতায় চব্বিশ আসে। চব্বিশ মানুষের, নব্বই মানুষের, একাত্তর তো অবশ্যই মানুষের। সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আবারও মানুষ মাটির জন্য যা লাগবে, মাটিকে তা-ই দেবেন। আবার মানুষ রাজপথে মরে যাবেন। জনতার কৃতিত্ব যদি কেউ কেড়ে নিতে চায়, কেউ বলবে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’; কেউ বলবে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’; কেউ বলবে ‘অমুকের কৃতিত্ব’—কিছুই মানব না। আপনি কোনোভাবে যদি মানুষকে ছোট করেন, বাচ্চাগুলোর রক্ত মাটিতে মিশে যাওয়ার ঘটনা ভুলিয়ে দিতে চান, আমরা সেটা মানব না।
একাত্তরের ধারাবাহিকতায় নব্বই আসে, একাত্তরের ধারাবাহিকতায় চব্বিশ আসে।ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। এক বছরের ব্যবধানে জুলাইয়ের নারীরা মুখ ফিরিয়ে নিলেন কেন?
সায়ান: আমি এটা করেছি, আমি ওটা করেছি—কৃতিত্ব নিয়ে দাপট দেখানো, নিজের ঢাক নিজেই পেটানোর প্রবণতাটা পরিসংখ্যানের হিসাবে মেয়েদের মধ্যে খুবই কম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের ছোট বোন প্রাপ্তি ফেসবুকে লিখেছে, ‘জুলাইয়ের নারীরা কোথায়?’ জুলাইয়ের নারীরা কেউ রান্নাঘরে, কেউ স্কুলে, কেউ চাকরিতে ছিলেন, যখন এই মাটির তাঁকে দরকার ছিল, বুক পেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবার নারী তাঁর নিজের কাজে ফিরে গেছেন। তাঁর সেই পুরুষালি প্রয়োজনটা নেই। অন্যদিকে পুরুষালি প্রবণতাটা সমাজে খুবই বিদ্যমান, সে নারীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান?
সায়ান: আমি চাই, দেশের প্রত্যেকটা মানুষ দেশের মালিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জনতার শক্তিশালী অবস্থান দেখতে চাই। আমি চাই, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মানুষের পক্ষে কাজ করবে। ক্ষমতায় যারা যাবে, তারা মানুষকে ভয় পাবে; মানুষের হাতে ভোটাধিকার ফিরে আসবে। সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা চাই; জনবান্ধব প্রশাসন চাই; নারীরা এগিয়ে যাবেন, সেটা চাই; অপরাধীদের বিচার হবে, সেটা চাই; ধর্ষণকারীদের জন্য দেশটা জাহান্নাম হবে, সেটা চাই।