মা রেজিয়া বেগমের সঙ্গে শাকিব খান। কোলাজ
মা রেজিয়া বেগমের সঙ্গে শাকিব খান। কোলাজ

শাকিব খানের মায়ের প্রথম সাক্ষাৎকার, ছেলে শাকিবকে নিয়ে কী বললেন তিনি

শাকিব খান—কেউ তাঁকে ভালোবেসে কিং খান ডাকেন। কেউ বলেন বাংলাদেশি সিনেমার সুপারস্টার, কেউবা মেগাস্টার। বাংলাদেশি সিনেমার এই প্রভাবশালী তারকার পরিবারের মানুষেরা থাকেন একেবারে আড়ালে। মা–বাবাসহ পরিবারের অন্য কাউকে কখনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি। প্রথম আলোর অনুরোধে শাকিব খানের মা রেজিয়া বেগম প্রথমবার কথা বললেন। মনজুর কাদের জানার চেষ্টা করেছেন মায়ের চোখে শাকিব খান কেমন? 

প্রশ্ন

আপনার ছেলে শাকিব খান এখন দেশসেরা নায়ক। জানতে চাই, ছোটবেলায় কোন বিষয়গুলোতে তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল?

রেজিয়া বেগম: আমার ছেলে পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। তাই এদিকটায় আগ্রহী ছিল বেশি, মনোযোগী ছিল। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে গণিতে ছিল বেশি আগ্রহ। এই বিষয়ে ছোটবেলা থেকে নম্বরও পেত বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে বন্ধুরা মিলে গানবাজনা করত। বন্ধুরা মিলে নাটকও করত। তবে পড়াশোনায় বরাবরই ছিল সিরিয়াস।

প্রশ্ন

আপনার ছেলের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটির কথা মনে আছে? কেমন অনুভূতি ছিল তাঁর?

রেজিয়া বেগম: ওর স্কুলজীবনের শুরুতে আমরা ধানমন্ডির দিকে থাকতাম। ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকার একটি স্কুলে ওর পড়াশোনার শুরু। স্কুলে যাওয়ার দিন তার সে কী উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা। সাধারণত ছোট বাচ্চারা স্কুলে যেতে গড়িমসি করত, ও ছিল পুরোপুরি উল্টো। নিজে নিজেই রেডি হচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, সে মহাখুশি। আগের রাতে নিজেই ব্যাগে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিল। 

গুলশানের বাসায় মা রেজিয়া বেগম ও বাবা আবদুর রবের সঙ্গে শাকিব খান।
প্রশ্ন

কোন কাজটা তিনি ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন?

রেজিয়া বেগম: দেশ–বিদেশের সবাই নায়ক হিসেবেই চেনে, জানে। কিন্তু ছোটবেলায় খেলাধুলা খুবই পছন্দ করত। ক্রিকেট নিয়ে সারাক্ষণ সে মেতে থাকত। এর বাইরে ঘুড়ি ওড়াতে খুব ভালোবাসত। 

প্রশ্ন

ছোটবেলার শাকিব খান কেমন ছিল—শান্ত নাকি দুষ্টু প্রকৃতির?

রেজিয়া বেগম: আমার ছেলেটা একেবারে শান্তশিষ্ট ছিল। মা যা বলত, সেটাই শুনত। যেখানেই বসিয়ে রাখতাম, সেখানেই থাকত। কোনো নড়াচড়া করত না। একেবারে লক্ষ্মী বাচ্চা বলতে যা, আমার মাসুদ (শাকিব খানকে মা–বাবা এই নামে ডাকেন) ছিল ঠিক তা–ই।

প্রশ্ন

একটা সময় স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হলো। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে শাকিব খান যখন বললেন, অভিনয় করবেন, তখন আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

রেজিয়া বেগম: মাসুদ তো তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। সামার ভ্যাকেশন যখন চলছিল, তখন একদিন আমাদের বলল ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে। আমরা কিন্তু মোটেও রাজি ছিলাম না। কারণ, একমাত্র ছেলেসন্তান, পড়াশোনায় যেহেতু ভালো ছিল, ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে পড়াতে পাঠাব। তা ছাড়া ওর নিজেরও ইচ্ছা ছিল, ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু কীভাবে যে কখন সিনেমায় ব্যস্ত হয়ে গেল। আমাদের বলেছিল, মাত্র ৩ মাস দেখবে। এরপর আর অভিনয় করবে না। আমরাও বলছিলাম, ঠিক আছে। তিন মাস কিন্তু। সেই তিন মাস তো এখন ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। ছেলে যেহেতু অভিনয়ে আনন্দ পাচ্ছিল, আমরাও ওর ইচ্ছায় বাধা দিইনি। ওর আনন্দটাই আমাদের আনন্দ মনে করেছি। 

মা রেজিয়া বেগম ও বাবা আবদুর রবের সঙ্গে শাকিব খান।
প্রশ্ন

শুরুতে তো সিনেমায় সফলতা সেভাবে পায়নি। তখন শাকিব খানের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল?

রেজিয়া বেগম: আমার ছেলে যখন যে কাজই করত, মনপ্রাণ দিয়ে করত। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করত। সিনেমায় যখন অভিনয় শুরু করল, তখনো সে বেশ নিবেদিত ছিল। এর মধ্যে প্রথম কয়েক বছর পার হয়েছে, কিন্তু যেভাবে সফলতা পাবার কথা হয়তো সেভাবে পাছিল না। কিছুটা মন খারাপ থাকত। মাঝেমধ্যে খাবার টেবিলে এসব নিয়ে আলোচনা হতো। ভিন্ন কিছু করবে কি না, সে প্রসঙ্গও আসত। কিন্তু মাসুদ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিল, কিছু একটা হবে, অভিনয়ে সে ভালো কিছু একটা করবে—এমনটা মনে মনে ছিল তার। ৩-৪ বছরে সেই চিত্র পাল্টাতে থাকে। তখন সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্প শোনাত। আমরাও জানতাম, ওর সিনেমা ভালো চলছে। তখন সিনেমা নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা বলত।

প্রশ্ন

কোন মুহূর্তে মনে হয়েছে, ‘হ্যাঁ, আমার ছেলে সত্যিই বড় কিছু হয়ে গেছে?’

রেজিয়া বেগম: সিনেমার অভিনয় ওকে দেশ–বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। মানুষের মনে জায়গা করে দিয়েছে। মানুষ তার যেকোনো বিপদ-আপদে ঢাল হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় টেলিভিশনে ও পত্রপত্রিকায় ওরে নিয়ে দারুণ সব গল্প শুনি। আত্মীয়স্বজন তারে নিয়ে গর্ব করতে থাকে। দেশ-বিদেশের মানুষও তাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। গর্ব করে। এসব দেখার পর বুঝতে পারি, মানুষজনের কাছে সে অনেক বড় কিছু হয়ে উঠছে। কিন্তু মায়ের কাছে তো ছেলেই, আমার মাসুদ।

মা রেজিয়া বেগমের সঙ্গে শাকিব খান (ডানে)।
প্রশ্ন

 আপনার কাছে শাকিবের সবচেয়ে বড় গুণ কী? আর সবচেয়ে দুর্বল দিক?

রেজিয়া বেগম: আমার ছেলেটা খুব ভালো মনের মানুষ। কখনোই কারও অমঙ্গল কামনা করে না। যতটা সম্ভব মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে, তা–ও আবার নীরবে-নিভৃতে। ছোটবেলায়ও ওর মধ্যে মানুষের জন্য মায়া–মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। যদিও এটা ভালো গুণ, তারপরও বলব এটাই তার দুর্বল দিকও—তা হচ্ছে, মানুষকে খুবই বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের কারণে বারবার ঠকেছেও। ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাজীবনে অনেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার ছেলে খুবই চাপা স্বভাবের। নিজের কষ্টের কথা সে কাউকে বুঝতে দেয় না। মাথায় রাজ্যের চাপ নিয়েও নিজের মানুষেরা যেন ভালো থাকে, সেই চেষ্টা করে।

প্রশ্ন

 তারকা হলেও সে কি এখনো মায়ের কাছে আদুরে ছেলে?

রেজিয়া বেগম: সবার কাছে আমার ছেলে তারকা, মহাতারকা; কিন্তু মায়ের কাছে আজীবনই সে আদুরে সেই ছেলেটি।

শাকিব খান
প্রশ্ন

শাকিবের কোন কাজটা দেখে আপনি সবচেয়ে বেশি গর্বিত হয়েছিলেন?

রেজিয়া বেগম: অনেক কাজই দেখেছি। তার সব কাজই দেখার চেষ্টা করি। এত এত কাজের মধ্যে অনেক কাজই আমাকে গর্বিত করেছে। আমি তো বাসায় রান্নাবান্না ও প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষে যেটুকু সময় পাই, টেলিভিশন চ্যানেলে ওর সিনেমাই দেখি। বাসার সহকারী যারা আছে, সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ওর সিনেমা দেখি। নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে আমার মেয়ে, জামাই, মাসুদের বাবাসহ আত্মীয়স্বজনের একটা বড় গ্রুপ মিলে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে যাই। আগের ছবিগুলোও যেমন দেখেছি, তেমনি ইদানীংয়ের ‘প্রিয়তমা’, ‘রাজকুমার’, ‘দরদ’, ‘তুফান’, ‘বরবাদ’—সবই দেখেছি। 

মা রেজিয়া বেগম ও বাবা আবদুর রবের সঙ্গে শাকিব খান।
প্রশ্ন

মায়ের হাতের রান্না করা কোন খাবারটা খেতে পছন্দ করেন?

রেজিয়া বেগম: মায়ের হাতে সব ধরনের খাবার ওর পছন্দের। এর মধ্যে খিচুড়ি, মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি সবচেয়ে বেশি পছন্দ। নানান পদের মাছও খেতে পছন্দ করে। যখন জিম শুরু করে, তখন খাবারের ধরন বদলে যায়। ডায়েট ফুডও মায়ের হাতেরটাই ওর সবচেয়ে পছন্দ।

প্রশ্ন

পরিবারে সে কতটা সময় দেয়? মা হিসেবে আপনি কি সময় পান যথেষ্ট?

রেজিয়া বেগম: আমার ছেলে পুরোপুরি পরিবার অন্তপ্রাণ। শুটিং ছাড়া সে সব সময় বাসাতেই থাকে। বাসার সবার সঙ্গে থাকতে ওর ভালো লাগে। বাইরে কোথাও আড্ডাবাজি বা হইহুল্লোড় করতে যায় না। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে মা হিসেবে যেটুকু সময় পাই, তা অনেক। এখন কাজ না থাকলে দুই সন্তান আব্রাহাম আর শেহজাদের সঙ্গে সময় কাটায়।

শাকিব খান
প্রশ্ন

আপনি শাকিবকে কোন পরামর্শ দিয়েছেন, যা তিনি সব সময় মনে রাখেন?

রেজিয়া বেগম: ছোটবেলা থেকেই একটা পরামর্শ দিয়েছি, ঠিকঠাক মতো চলবে, মানুষের উপকার করবে, যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে। আমি দেখেছি, সেই পরামর্শ এখনো সে মনে চলছে। 

প্রশ্ন

মা হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন শাকিবের জন্য কী?

রেজিয়া বেগম: মায়ের দোয়া ওর সঙ্গে সব সময় থাকে। আমার ছেলের কয়েকটা স্বপ্ন আছে—সেই স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। 

প্রশ্ন

আপনার চোখে শাকিব কেমন মানুষ—নায়ক নয়, ছেলে হিসেবে?

রেজিয়া বেগম: আমার সন্তান খুবই ভালো, খুবই নরম প্রকৃতির, অমায়িক। তবে যেকোনো অন্যায় অনিয়ম দেখলে কিন্তু রেগে যায়—এটা তার পরিবার ও কাছের মানুষেরা উপলব্ধি করেন।