মোশাররফ করিম
মোশাররফ করিম

মানুষ যখন ভালোবাসতে শুরু করবে, তখনই সফলতাটা আসবে: মোশাররফ করিম

যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে ‘৮ম বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ডালাস ২০২৫’-এ প্রদর্শিত হবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আবর্ত-দ্য সার্কেল’। মাহমুদুল হাসান টিপু পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। এর বাইরে সম্প্রতি সিরিজ ও চলচ্চিত্র ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’, ‘২ষ’, ‘চক্কর ৩২০’, ‘ইনসাফ’ দিয়ে আলোচনায় এই অভিনয়শিল্পী। এসব নিয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এই অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে কথা বললেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

‘আবর্ত-দ্য সার্কেল’ যুক্তরাষ্ট্রে বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ডালাস উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে—খবর যখন প্রথম পেলেন, ঠিক কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

মোশাররফ করিম : একটু এক্সাইটেড এই কারণে হয়েছি, কাজটি ছিল নিরীক্ষাধর্মী। আমরা সবাই একটা টিম হয়ে কাজটা করেছি। উৎসবে পাঠাবে এমন ভাবনা কাজ করার সময় ছিল না। বছরখানেক আগে কুয়াকাটায় শুটিং করেছি। কাজটা করেও আরাম লাগছিল। আমরা সময় নিয়ে, আনন্দ নিয়ে পুরো কাজটা করেছি। তবে এই কাজটা নিয়ে জুঁই (রোবেনা রেজা, মোশাররফ করিমের অভিনয়শিল্পী স্ত্রী) অনেক পরিশ্রম করেছেন, তাই মূল কৃতিত্বটা দেব তাঁকে। পরিচালক টিপুকে দেব। শুটিং শেষে দেখলামও কাজটা দারুণ হয়েছে। পরিচালক তাঁর মতো করে ছবিটি উৎসবে পাঠিয়েছেন। কদিন আগে আমাকে যখন জানাল, তখন আমি বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম। ভেবেছি, সৎ চিন্তা থেকে একটা জিনিস নিয়ে পরিশ্রম করলে তার ফলাফল আছেই, এটাই মনে হয়েছে।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আবর্ত-দ্য সার্কেল’ এর দৃশ্যে রোবেনা রেজা জুঁই ও মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

 পরিচালকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানলাম, ২৩৮টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা থেকে উৎসব কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪টি চূড়ান্ত করেছে। ছবিটিতে এমন কী আছে, যা উৎসব কর্তৃপক্ষের মনে ধরেছে বলে আপনি মনে করেন?

মোশাররফ করিম : মানুষের ভাগ্য যে তার হাতে না, প্রকৃতির ওপর যে তাঁর নির্ভরশীলতা এবং প্রকৃতির ওপর তাঁর অসহায়তা—সেটাই সব সময় আমরা দেখে আসছি, বলে আসছি। কোনো কিছুতেই চূড়ান্ত কোনো ফাইট দেওয়ার মতো আমরা কেউ না। সবকিছুরই অনিশ্চয়তা আছে। এই গল্পে সেটাই একটু ভিন্ন উপায়ে বলা হয়েছে। আবর্ত একটা মেয়ের সংগ্রামের গল্প, যে গল্পে তার স্বামী মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে। অনেক দিন আর খোঁজ নেই। বেশ কয়েক বছর পরও সেই মেয়ে ভাবতে থাকে, তার স্বামী মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে—এ নিয়ে চলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। একবার মনে হয়, আবার যদি ফিরে আসে। এর মধ্যে আরেকজন মানুষের তার প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা তৈরি হয়। কিন্তু  দ্বন্দ্বের কারণে সে তাকেও গ্রহণ করতে পারছে না। প্রকৃতি একটা মানুষকে নিয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটা একটা জায়গায় আটকে আছে, সিদ্ধান্তহীনতার যে দ্বান্দ্বিক বিষয়টা, হয়তো উৎসব কর্তৃপক্ষের এই বিষয়টা ভালো লেগেছে।

প্রশ্ন

তিন দশকের অভিনয় জীবনে মঞ্চ, নাটক চলচ্চিত্র ও ওটিটিতে অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে আপনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তা আপনার কতটা চেনাজানা ছিল? নাকি এটি ছিল একেবারেই নতুন রকম এক চ্যালেঞ্জ?

মোশাররফ করিম : আমার কাছে কোনো চরিত্রই চেনা জানা মনে হয় না। যখন সমাজের চারপাশে দেখি, তখন প্রতিটা চরিত্র নতুন মনে হয়। আসলেই নতুন। আমরা সময় নিয়ে সেই চরিত্র করতে পারি কি না, সেটা বিষয়। অধিকাংশ সময় যতটা সময় দরকার তা নিয়ে করতে পারি না। আসলে এই চরিত্রটাও নতুন। আমার জন্য চ্যালেঞ্জ যতটা ছিল, অভিনয়ের জায়গায় তার চেয়ে বেশি জুঁইয়ের জন্য ছিল। নিশ্চয় সে উতরে গেছে।

‘চক্কর ৩০২’ সিনেমায় মোশাররফ করিম।
প্রশ্ন

‘আধুনিক বাংলা হোটেল’, ‘২ষ’, ‘চক্কর ৩২০’ এবং ‘ইনসাফ’—এই সব কাজগুলোতে আপনি যেন নতুন এক মোশাররফ করিম। ওই যে আপনি বলছিলেনও প্রতিটা চরিত্রই নতুন। ইচ্ছাকৃতভাবে কি একটু অন্য রকম চরিত্র বেছে নিচ্ছেন?

মোশাররফ করিম : না, আমার কাছে এসব চরিত্রের প্রস্তাব আসে। আমি তা একটু নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করি এখনো। যেমন নুহাশ হ‌ুমায়ূনের ‘২ষ’ তে যে চরিত্রে অভিনয় করেছি, সেটা তো আমার কাছে খুবই দুর্দান্ত চরিত্র মনে হয়েছে। আর ‘চক্কর ৩০২’ এবং ‘ইনসাফ’-এও ভিন্ন রকম চরিত্র।

প্রশ্ন

এখন তো আপনি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও নিয়মিত কাজ করছেন। এখানে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? এখানে কি আপনি অভিনয়ের জায়গায় আরও বেশি স্বাধীনতা পান?

মোশাররফ করিম : এটা ঠিক, ওটিটিতে একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। স্বাধীনতা ওটিটিতে যেমন পাই, টেলিভিশনেও পাই। স্বাধীনতার ব্যাপারটা হচ্ছে, এটা সম্মিলিত কাজ তো, সবারই ইনপুট থাকে। আমার মাথায় চরিত্র নিয়ে একটা ভাবনা এল, সেটা নিয়ে আমাকে তো পরিচালকের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। দুজন মিলে যখন একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারব যে হ্যাঁ এটাই ঠিক, যেতে পারি, ঠিক আছে—তখনই তো ঠিকঠাকভাবে কাজটা হবে।

প্রশ্ন

কাছাকাছি সময় অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে এত এত ভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে গিয়ে কখনো নিজের ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়?

মোশাররফ করিম : দ্বন্দ্ব তো ভীষণভাবে তৈরি হয়। আমার অনেকবার মনে হয়েছে, এই চরিত্রটা তো কিছুদিন আগে করা ওইটার মতো। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে এর মধ্যে ভিন্নতা আনা যায় কীভাবে চিন্তা করতে থাকি। কারণ, সব চরিত্রের মধ্যেই তো কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে। একই পরিবারে দুই ভাই প্রায়ই একই রকম, তারপরও তো কিছু ভিন্নতা থাকে। সেই কিছুর দিকে নজর দিতে থাকি, এটা ছাড়া তো উপায় নেই।

মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

নাটক, সিরিজ ও চলচ্চিত্রে চরিত্র বাছাইয়ে এখন কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়—গল্প, নির্মাতা, না চরিত্রের গভীরতা?

মোশাররফ করিম : আমার কাছে সবগুলো। মূলত নির্মাতা ভালো না হলে সে ভালো গল্প নির্বাচন করবে না। তবে অভিনয়শিল্পীকে নিজের চরিত্রের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়, কারণ পারফর্ম তো তাকেই করতে হয়। সে ক্ষেত্রে চরিত্রটা আমার মনে লাগতে হবে। চরিত্রটা মনে না লাগলে তো পারফর্ম করতে পারব না।

প্রশ্ন

একজন অভিনেতা হিসেবে আপনি এখন কোন ধরনের চরিত্রে নিজেকে দেখতে চান, যা আপনি আগে পাননি?

মোশাররফ করিম : ‘যমজ’ নাটকটা যখন করলাম, বৃদ্ধ চরিত্র ভীষণ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে। এ রকম একটা বৃদ্ধ লোক, একই সঙ্গে কৃপণ ও ধূর্ত। আমার যে বয়স, সে বয়সে ওই চরিত্রটার মনস্তত্ত্ব ধরতে পারা, বেশ টাফ ছিল। তবে প্রচারের পর সবাই গ্রহণ করল। আমি আসলে অনেক ধরনের চরিত্র করেছি। তবে ম্যাচিউরড দ্বন্দ্বপূর্ণ চরিত্রের আকাঙ্ক্ষা আগে ছিল, এখনো আছে।

প্রশ্ন

দীর্ঘ সময়ের পথচলায় অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আপনি কি কখনো কোনো চরিত্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন, এমন অভিজ্ঞতা কি হয়েছে?

মোশাররফ করিম : অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি কচি ভাইয়ের (কচি খন্দকার) কথা বলব, তিনি আমাকে সত্যি বলতে দারুণ সব চরিত্র দিয়েছেন। একটা চরিত্রের কথা বলব, সম্ভবত নাটকের নাম ‘নো কোশ্চেন নো আনসার’ যেটাতে আমি আধা পাগলের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এই আধা পাগলের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে মুশকিল বোধ করলাম। ভাবলাম, এটা করব কী করে। পাগলের চরিত্রে অভিনয়ে তো চ্যালেঞ্জ—সে চরিত্রে ডুব দেব কীভাবে, অভিজ্ঞতা তো নেই। একজন পাগলকে যখন আমরা দেখি, তার বাহ্যিক দিকটা দেখি, তার মানসিক দিকটা দেখার উপায় নেই। তাই এই চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন। সেই চরিত্রের মুশকিল হচ্ছে, পাগল হলেও মানুষের কথা বোঝে, ডাব বিক্রি করে, বিয়েবাড়িতে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে। চরিত্রটায় অসংগতি আছে, আবার সামাজিকও—তাই চরিত্রটা করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে একটু কল্পনার আশ্রয় নিলাম। ভাবতে থাকলাম, এমন চরিত্রের মানুষের শারীরিক গঠন কেমন হতে পারে, হাঁটাচলার ধরনটা কেমন হতে পারে, কণ্ঠটা কেমন হতে পারে—একটা ধারণা পেলামও। পরে শুনেছি এ রকম চরিত্র বাস্তবেও ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, নাটক প্রচারের পর একদিন কচি ভাই ফোন করে জানালেন, কুষ্টিয়া থেকে একজন মানুষ তাঁর কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন, মোশাররফ করিম ভাই কি হাসান পাগলকে দেখেছে? কচি ভাই বলেন, না, ও-তো দেখে নাই। দেখে নাই, তাহলে হুবহু করলেন কীভাবে? কারণ, হাসান পাগলার সঙ্গে চরিত্রটা মিলে গেছে। এটা শোনার পর তখন আমার কাছে অবাক লাগল। ভাবলাম, দেয়ার ইজ সামথিং স্পিরিচুয়াল। এটা আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কচি ভাই আমাকে সত্যিই কিছু অসাধারণ চরিত্র দিয়েছেন, তিনি চরিত্র নির্মাণ করতে ওস্তাদ।

‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

অনেক অভিনেতা সময়ের সঙ্গে পরিচালনায় আসেন বা স্ক্রিপ্ট লেখেন। আপনি...

মোশাররফ করিম : মাঝে মাঝে পরিচালনার কথা ভাবি। আমি আসলে মানুষ হিসেবে গোছানো না তো, তাই আবার পিছিয়ে আসি। মাঝে মাঝে ভাবতে থাকি, আমি যদি পরিচালক হতাম, ক্যামেরাটা যদি এই জায়গায় বসাতাম, এই লেন্সে দৃশ্যটা শুটিং করতাম, আলোটা এ রকম দরকার ছিল, সংলাপটা এ রকম দিতে পারলে ভালো হতো। এই ভাবনাগুলো কেন হচ্ছে, ভেতরে এই বিষয়ে হয়তো ধারণা তৈরি হয়েছে, একটা আগ্রহও তৈরি হয়েছে। সেই কারণে এই ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ঘোরে। সেই জায়গা থেকে মনে হয়, কখনো পরিচালনা করলেও করতে পারি। তবে এটা কবে, কখন হবে তা জানি না। আবার দেখা যাবে, হয়তো কোনো দিনই আসা হবে না। দেওয়া হয়নি। বহু কাজই করা হয়নি।

প্রশ্ন

অভিনয়শিল্পে আপনি এত বছর কাজ করছেন, আপনি জনপ্রিয়, সফলও। আপনার কাছে ‘সফলতা’ শব্দটার মানে কী?

মোশাররফ করিম : আমার কাছে ভালোবাসাই হচ্ছে সফলতা। রুমীর বক্তব্য ‘লাভ ইজ দ্য ব্রিজ বিটুইন ইউ অ্যান্ড এভরিথিং’। আমার কাছেও এটা খুব মনে হয়। এই জীবনে আমি যা কিছু ভালোবেসেছি, তাই আমি পেয়েছি। আর যেসব বিষয়ের প্রতি আমার লোভ কাজ করেছে, তা আমি পাইনি এবং তাতে আমার ক্ষতি হয়েছে। অথবা যেটা পাইনি ওই জিনিসটার ব্যাপারে আমি হয়তো খুব ক্রেজি ছিলাম। এখন মানুষের বড় মুশকিলই হচ্ছে, মানুষ খুবই অস্থির। পুরো বিশ্বের অবস্থাও তো তাই। মানুষকে অস্থির করে তুলছে। একটা মানুষকে কি বলা যাবে, এক দিনের জন্য আপনার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিলাম, আপনি এটা ব্যবহার করতে পারবেন না। এটার পর হয়তো সে এলোমেলো, অস্থির হয়ে যাবে। অথচ একটা মানুষের তো স্থিরতা খুব প্রয়োজন। একটা মানুষ কিছুই করছে না, শুধুই বসে আছে—সেটাও তো এই জীবনে দরকার আছে। ওই যে ধৈর্য বা স্থিরতা সেখান থেকেই তো জন্ম নেবে। মানুষ যখন স্থির না, মানুষের দৃষ্টিও তো স্থির হবে না, ফোকাসও স্থির হবে না। যখন দৃষ্টি স্থির হবে সেখান থেকে ভালোবাসার জন্ম নেবে। মানুষ যখন ভালোবাসতে শুরু করবে, তখনই মানুষের সফলতাটা আসবে।

প্রশ্ন

যদি একদিন অভিনয় ছেড়ে দিতে হয়, আপনি কী নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চান?

মোশাররফ করিম : ছেড়ে দিতে হয় কী, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অভিনয়টা ছেড়েই দেব। কিন্তু আমি দেখছি এটাতে ১০-১২ দিনের বেশি থাকতে পারি না। মনে হয়, ১০-১২ দিন আগে যেটা ভাবছি সেটা ভুল ভাবছি। মনে হয়, আমি অন্য কোনো কিছু করতে পারছি না। পারব না। আমি তো উপভোগ করিও না। আমার চাকরি করতে হবে, এটা ভাবতেই পারি না। আমার আবার অন্য ক্রিয়েটিভ কাজ যেমন লেখালেখি করতে ইচ্ছা করে। সাংবাদিকতা করতেও ইচ্ছা করে। অনেক আগে থেকেই আমার মনে হয়, আমি তারিক ভাইয়ের (তারিক আনাম খান) ইন্টারভিউ নিই। এটা প্রায়ই মনে হয়। অনেক সময় হায়াত ভাইয়ের (আবুল হায়াত) ইন্টারভিউ নিতে ইচ্ছে করে, দীর্ঘ ইন্টারভিউ।

তারিক আনাম খান ও মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

সাংবাদিকতা করার ইচ্ছা কেন করে?

মোশাররফ করিম : সাংবাদিকতার সৃজনশীলতা হচ্ছে একজন মানুষকে বের করে নিয়ে আসা যায়, উপলব্ধি সম্পর্কে জানা যায়। আলাপ-আলোচনা কী আসলে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে—আমি নিজে সমৃদ্ধ হব, সেই আলোচনা দেখে বা পড়ে অন্যরাও সমৃদ্ধ হবে, আনন্দিত হবে। নতুন দিক সম্পর্কে জানতে পারবে। কোনো দিন অভিনয় ছেড়ে দিলে সাংবাদিকতা করতেও পারি। এই পেশাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধাও করি।

প্রশ্ন

দর্শকেরা আপনাকে একধরনের চরিত্রে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আপনি কি কখনো তাদের সেই প্রত্যাশার বাইরে যেতে ভয় পান?

মোশাররফ করিম : আমি ভয় পাই না। ভয় যে পাই না, তার উদাহরণও অনেক। সব দর্শকের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গা সব সময় আছে। আমার মনে হয়, মানুষ আনন্দিত হতে চায়, বিনোদিত হতে চায়, হাসতে চায়। মানুষ কখনো কাঁদতে চায় না। এই যে মানুষের চাওয়া, সেই চাওয়াটাকে তো শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। আমার জীবনে দুটি উদাহরণ আছে। করোনার সময় একজন চিকিৎসক বললেন, মোশাররফ ভাই, আমার করোনা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। আমাকে আপনার কয়েকটা নাটক পাঠান, আমি দেখতে চাই। আমি খুব বিষণ্ন হয়ে গেছি, আমার ভেতর খুব ভয় কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কয়েকটা নাটকের লিংক পাঠালাম। পরে তিনি আমাকে বললেন, তিনি স্বস্তি অনুভব করেছেন। আরাম লেগেছে তাঁর। তখন আমার মনে হয়েছে, এই যে কমেডি বলি, হিউমার বলি—এটা তো আসলে চিকিৎসা। এটা তো হিলিং। দারুণ একটা ব্যাপার। আমাকে গুণ দাও (নির্মলেন্দু গুণ) ‘সিকান্দার বক্স’ নাটকটা দেখে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত তখন অস্বস্তিতে ছিলেন। দেখা শেষে ফোন দিয়ে তিনি বললেন, আমি নাটকটা দেখলাম। খুব ভালো লাগল। আনন্দ পেলাম। তখন মনে হলো, আমরা শিল্পীরা আসলে কী করছি। মাঝে মাঝে মনে হয় না, অর্থহীন সবই করছি। জীবনে কোনো কিছুই আসলে অর্থহীন না, যদি তা মন দিয়ে করা যায়। জিনিসটা হয়ে ওঠাটা আসলে বড় কথা। আমি একটা ট্র্যাজেডি করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেটা তা হয়ে উঠল না। সেটা যদি হয়ে না ওঠে তাহলে ব্যর্থ। আমি একটা কমেডি করলাম, সেটা যদি তা না হয়ে ওঠে, সেটাও ব্যর্থ। মোটকথা, জিনিসটা ঠিকঠাক হতে হবে। ট্র্যাজেডি ভালো, কমেডি খারাপ বা কমেডি ভালো ট্যাজেডি খারাপ—এসব ব্যবচ্ছেদের কোনো অর্থই না। এটা হালকা ওইটা ভারী—এসবের কোনো মানে হয় না। আমি সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে কচুরিপানার সঙ্গে গোলাপ ফুলের সৌন্দর্যকে আলাদা করতে চাই না। সব রূপই আলাদা। সব রূপই রূপ। কচুরিপানার যে রং বা গঠন বা পানির মধ্যে হয়ে থাকাটা, তা তো আমি গোলাপের মধ্যে পাচ্ছি না। আমি যখন কোনো রূপকে অস্বীকার করব, সেটা একরকম বেইমানিও, বেইমানি এই অর্থে যে স্রষ্টার ক্ষেত্রে।

মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

অভিনয় করতে করতে কখনো কি নিজের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন অনুভব করেছেন?

মোশাররফ করিম : অভিনয় করতে করতে না, মানুষ আসলে ধীরে ধীরে, টেরও পায় না, তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। আমি যখন থেকে সিরিয়াসলি থিয়েটার করি, সেই নব্বই সাল থেকে, যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখনকার যে মানুষটা, আমার সে সময়ের ম্যাচিউরিটি আর এখনকার আমার মধ্যে তো বিস্তর ফারাক আছে। কিন্তু চলার পথের রেখাটা এক। হয়তো একই পথে চলছি কিন্তু একই পথে চলতে চলতে তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস পাওয়া, বিভিন্ন জিনিস আমার ভেতরে ঢুকে গেছে, তা দিয়েই তো এখনকার আমি।

প্রশ্ন

এই যে এখনকার আমি তখন প্রতিদিনের ব্যস্ততা শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলেন নিজেকে?

মোশাররফ করিম : আমার নিজের সঙ্গে নিজের কথা প্রতিদিনই কিছু না কিছু হয়। এটা কিন্তু সচেতনভাবে না। একা দাঁড়ালেই নিজের সঙ্গে নিজের কথা হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা হয়। শুনলে হয়তো হাস্যকরও লাগবে।

প্রশ্ন

বলেন না শুনি আপনার সেই চিন্তাটা।

মোশাররফ করিম : আমার কাছে এই দুনিয়াটা নিয়ে চিন্তা হয়। এত সব আয়োজন, এই আধুনিকতা, স্যুট-বুট-কোট-টাই, প্রচুর শিক্ষা, প্রচুর ডক্টরেট—পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটল আসলে। পৃথিবীতে তাহলে এত যুদ্ধ, হানাহানি, মারামারি কেন?—এ রকম মনে হয় আরকি। তাহলে মানুষ আসলে কত দূর এগোল। মানুষ কি আদৌ এগোল কি না। মানুষের মূল্যবোধের শিক্ষা, মানুষের হৃদয়ের শিক্ষা, হৃদয় কি আদৌ সমৃদ্ধ হলো? পৃথিবীতে অনেক আবিষ্কার হলো, আমরা এত উন্নয়ন করলাম, আত্মিক উন্নয়ন জগৎজুড়ে কতটুকু হলো? একলা একলা থাকলে এসব ভাবতে থাকি, খুব অবাক লাগে। আবার ভাবতে থাকি, এসব কথা তো বোকা বোকা শোনায়। মানুষ ভাববে, কি সব ভাবছি আমি। কিন্তু এটা আমার হয়। তখন হতাশও লাগে। ভাবতে থাকি, কী করছি, কেন করছি। তারপর আবার প্রায়ই মনে হয়, আমি নিজের জন্যই করছি। নিজে আনন্দিত হওয়ার জন্য কাজ করছি। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, এটা আমার কথা না, প্রমথ চৌধুরীর সেই কথাটা আমার দারুণ পছন্দের, ‘আনন্দ সংক্রামক’। আনন্দ হচ্ছে সংক্রামক, তাই তুমি আনন্দিত হও। কারণ তুমি যদি আনন্দিত হও, তাহলে আনন্দ সংক্রামক, আনন্দ ছড়াবে। আরেকজনকে আনন্দিত করার জন্য যুদ্ধ করার দরকার নেই। আরেকজনকে আনন্দিত করার জন্য যুদ্ধ করলে সেটা যুদ্ধই হবে, সেখানে আনন্দ প্রতিষ্ঠা হবে না।

মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

মানুষ কাজ করতে করতে একটা সময় থামে। কেউ বলে, সময়টা থেমে গেছে। সময়টা যখন থেমে যায়, আপনি কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি ফিরে পেতে চান?

মোশাররফ করিম : অনেকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে। আমি সামনে এই হব, এরপর ওই হব, তারপর এটা হবে, সেটা হবে। এটা আমার জীবনে কখনো ছিল না, এখনো নেই। আমি জানি না, সামনে কী হবে। আমার কাছে খুব ট্র্যাজেডি মনে হয়, মানুষ বর্তমানকে উপভোগ করতে পারে না, যেমন আমিও পারি না। বর্তমানটা যখন অতীত হয়ে যায়, তখন অতীতের কথা মনে পড়লে সেটার স্বাদ বড় ভালো লাগে। তখন মনে হয়, কী সুন্দর দিন কাটিয়েছিলাম। তো বর্তমান সব সময় উপভোগ্য না। আবার কোনো কোনো বর্তমান তো খুবই উপভোগ্য, যেটা আসলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময়টা দারুণ উপভোগ্য। ওইটা আমার একটা রসদ। ফিরে পেতে চাই বলতে, যেটা আমাকে খুব টানে, এটা হয়তো সব লোককেই টানে, ছোটবেলা। আমার কিন্তু মাত্র ৫ বছর গ্রামে, ক্লাস ফাইভ টু টেন। কিন্তু এই ৫ বছরই আমার ৫০ বছর মনে হয়। কারণ, ওই ৫ বছরে আমি খাঁটি গ্রাম দেখছি। একদম কাদামাটির গ্রাম, অমাবস্যার গ্রাম, পূর্ণিমার গ্রাম—ইলেকট্রিসিটি ছিল না তো, সেটা আমি খুব মিস করি। এ রকম হয় যে সেখানকার মানুষকেও খুব মিস করি। তার মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, তাদেরও মিস করি, ছোটবেলার বন্ধুদের মিস করি।

প্রশ্ন

আপনি কীভাবে চান মানুষ আপনাকে মনে রাখুক—একজন অভিনেতা হিসেবে, না একজন ভাবুক মানুষ হিসেবে?

মোশাররফ করিম : আমাকে কেউ মনে রাখবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত না। তবে সবকিছু মিলিয়ে মানুষ আমাকে ভালোবাসুক, এটা খুব চাই। তবে এটাও ঠিক, আমি যদি তাদের মধ্যে ভালোবাসা ছড়াতে পারি, তাহলে তো তারা আমাকে ভালোবাসবে। নয়তো নয়।

মোশাররফ করিম
প্রশ্ন

 অনেক সময় দিলেন, ধন্যবাদ।

মোশাররফ করিম : অনেক দিন পর কথা বলে আমারও খুব ভালো লাগল। অনেক কথা বললাম, এমনটা বলা হয় না।