পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গান গাইছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন তিনি। যুক্ত আছেন সমাজসেবামূলক নানা কার্যক্রমে। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর বরেণ্য এই শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন, আজ জীবনের আরেকটি নতুন বছর শুরু করলেন তিনি। জন্মদিনসহ নানা প্রসঙ্গে গতকাল তাঁর সঙ্গে কথা বলল বিনোদন
আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না...
আমি তো সকালে কলকাতায় এসেছি। কোক স্টুডিও কনসার্টে গাইতে। ১৮ নভেম্বর গাওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু কাজ আছে।
Also Read: ৭০-এ পা রাখলেন রুনা লায়লা
তাহলে তো এবারের জন্মদিন কলকাতায় কাটবে...
তা ছাড়া উপায় নেই। অনেক আগে থেকেই এ অনুষ্ঠান নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাই জন্মদিনের টেলিভিশন অনুষ্ঠান ঢাকায় অগ্রিম রেকর্ড করে এসেছি। চ্যানেল আই বিশেষ অনুষ্ঠান তৈরি করেছে।
গত বছর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আপনার বয়স ১৭ বছর। এবার বাড়ল, নাকি ওখানেই থেমে আছে?
কোনো বয়স বাড়েনি। বয়স আমার ওখানেই আটকে আছে (হাসি)।
Also Read: কোক স্টুডিও বাংলায় রুনা লায়লা
বয়স এক জায়গায় আটকে রাখার রহস্য কী?
মনটায় তারুণ্য ধরে রাখলে বয়সও আটকে থাকে। খুবই সিম্পল হিসাব (হাসি)।
এই তরুণ মনে কী কী করতে ইচ্ছা হয় আপনার?
আগে যা করতাম, তা–ই। খাও, দাও, ফুর্তি করো। জীবনটাকে উপভোগ করো।
জীবনের মানে আপনার কাছে কী?
জীবন মানে ইতিবাচকভাবে সবকিছু দেখা। নিজে ইতিবাচক থাকলে সবকিছুই ঠিক। মনের জোর থাকতে হয়। মনের জোর থাকলে অনেক বাধা অতিক্রম করা যায়। আমার জীবন হচ্ছে, আমার গান ও পরিবার। পরিবার নিয়েই আমার জীবনটা।
Also Read: নানান রঙের রুনা লায়লা
বাধার কথা বলছিলেন। কিন্তু আপনার সফলতার খবর সবাই জানেন। আপনার পথচলা সহজ ছিল কি?
বাধা তো অনেক এসেছে জীবনে কিন্তু একটা বিষয় হচ্ছে, কারও কাছে কোনো দিন যেচে কাজ চাইতে হয়নি। আমাকে দিয়ে গান গাওয়াও, এটা বলতে হয়নি। আল্লাহর রহমতে সবাই আমার নিজের কাছেই এসেছে গানের প্রস্তাব নিয়ে। বাধা এলে ওপরওয়ালা বিচার করেন, তিনি একজন তো আছেন, সব দেখেন।
বাধা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন? হতাশ হয়েছিলেন কি না?
কখনোই ভেঙে পড়িনি। ওপরওয়ালার ওপরে অনেক বেশি বিশ্বাস ছিল। সব সময় ভেবেছি, আমার মধ্যে যদি ট্যালেন্ট থাকে, সব বাধা অতিক্রম করব। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এটা কোনোভাবে আমাকে মন খারাপ বা হতাশায় পড়তে দেয়নি। সবচেয়ে বড় বিষয়, আমার পরিবারের সদস্যরা সব সময় পাশে ছিল।
গানের কারণে আপনার শ্রোতারা আপনাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু এই অঙ্গনের ভেতরকার নোংরা রাজনীতির খবর তো তাঁরা জানতেন না। এসব বাধা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন?
আমি যে নানাভাবে বাধার মুখোমুখি হয়েছি, এসব নিয়ে তো তখন অনেক লেখালেখি হয়েছে। তাই আমার গান সম্পর্কে যেমন শ্রোতারা জানত, তেমনি আমার সঙ্গে যা ঘটছে, এসবও তারা জানত। আমার পরিবারও জানত। এত বেশি লেখালেখি হয়েছিল যে আমার কাউকে বলতেও হতো না। আমার সঙ্গে কেন এমনটা হচ্ছে, সেটাও ভক্তদের বুঝতে সমস্যা হয়নি। আর এসব নেতিবাচক বিষয়ে আমি উত্তেজিত হয়েছি বা ভয় পেয়ে গেছি, তেমনটা কখনো ঘটেনি। যারা আমাকে নিয়ে নেগেটিভিটি ছড়াচ্ছে, তাদের ভুল একদিন ভাঙবে, এই বিশ্বাস ছিল। সব সময় ভেবেছি, আল্লাহ তাআলা সব দেখছেন, ভালো করলেও সেটার বিচার পৃথিবীতে পাওয়া যায়, খারাপ করলেও হয়। তাই মন থেকে কখনো কাউকে বদদোয়া দিইনি, দেবও না। সব সময় যারা আমার বিপক্ষে গেছে, তাদের সম্পর্কে ভালোই বলেছি। আমি আমার মতো আছি। গান নিয়ে আছি, পরিবার নিয়ে হ্যাপি আছি। তাই কে কী বলল, তা নিয়ে আমার কিছু যায়–আসে না। পরোয়াও করি না। আমি সব সময় সোজা পথে চলেছি। কারও ক্ষতি করিনি, করার ইচ্ছাও ছিল না, নেইও। কোনো দিন হবে না। যতটা পারব মানুষের উপকার করব, সে যতটা আমার সঙ্গে খারাপ করুক। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা কোনো দিন জাগেনি, জাগবেও না। আমি সে ধরনের মানুষও নই।
এই শিক্ষা কোথা থেকে পেয়েছেন?
বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, তখন মা-বাবার কাছ থেকেই আসল শিক্ষাটা নেয়। কোন পথে চলতে হবে, কোন পথ সহজ, কোনটা বাঁকা, এটা তাঁরাই শিখিয়ে দেন। তাঁদের শেখানো পথেই আমরা বড় হই। আমরা শিখেছি, কারও ক্ষতি করবে না, পারলে উপকার করবে। সেটা সারা জীবন আমরা তিন ভাইবোন মেনে চলেছি। এখনো চলছি।
মা নাকি বাবা, আপনার জীবনে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি?
মা তো আমার সঙ্গে সব সময় থাকতেন। ছোট বয়স থেকে গান গাওয়া শুরু করেছি। আব্বাও থাকতেন। দুজনেরই সমর্থন ছিল। বড় বোনেরও ছিল। ভাইয়েরও। তবে মায়ের খাটুনি বেশি হয়েছে। সবারই অবদানে আমি।
শুনেছি, আপনি যখন বাংলাদেশে এসে গাইছিলেন, তখন একটা বড় বাধা এসেছিল। কী হয়েছিল সেই সময়?
আমি গান গাইছিলাম। ভালো চলছিল। একটা ঘটনার পর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তখনকার সব শিল্পী বয়কট করল। হঠাৎ করে তারা বলল, আমার সঙ্গে কেউ গাইবে না। একই স্টেজে দাঁড়াবে না। কোনো মিউজিশিয়ান আমার সঙ্গে বাজাতে পারবে না! কোনো স্টুডিও রেকর্ডিং করতে পারবে না।
কী সেই কারণ ছিল?
সেসব কারণ এখন আর বলে লাভ নেই। সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। হয়তোবা কারও কারও আমার প্রতি রাগ ছিল। তবে একটা বিষয় আমাকে তখন খুব কষ্ট দিচ্ছিল; কারণ, যে সময়টায় আমাকে বয়কট করা হয়েছিল, ওই সময়টায় আমার বড় বোনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তার ক্যানসার ধরা পড়ে। সে তখন খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ছিল। আমি ওটা নিয়ে এত চিন্তিত ছিলাম, তারপরও ওদের সংস্থার অনুষ্ঠানে যাই, সবই করি। কিন্তু তারপরও আমার সঙ্গে যা হয়েছিল, তা আজও জানি না। পারভেজ (মাসুদ পারভেজ) সাহেব উদ্যোগ নিয়েছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘কিসের কী বয়কট। আমি এসব মানি না। আমি প্রযোজক, যাকে খুশি তাকে দিয়ে গাওয়াব। এখানে কেউ আমাকে বলার কিছু নেই।’ আমার এক সহশিল্পী ছিলেন, তিনি স্টুডিওতে আমাকে দেখে বইটই ছুড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘রুনা লায়লার সঙ্গে গান গাইব শুনলে আমি তো আসতামই না।’ যাক, শেষ পর্যন্ত দ্বৈত গান আমি একাই গেয়েছি। ঘটনাটা ইপসা স্টুডিওতে ঘটেছিল।
এই বয়কট কত দিন ছিল?
খুব বেশি দিন না। সবাই দেখল, আমি ছবিতে গান করছি, কেউ মানছে না। মিউজিশিয়ানরাও বাজাচ্ছে। মিউজিক ডিরেক্টররাও কাজ করছে। এসব বয়কট করে তো লাভ হচ্ছে না। তখন একটা সময়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। আচ্ছা, আমার রিহার্সালে যেতে হবে। অনেক কথাই বলেছি।
এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
তোমাকেও ধন্যবাদ।