
গায়ক, সংগীতায়োজক ও অভিনেতা—তিন ক্ষেত্রেই সফল প্রীতম হাসান। সময়ের ব্যস্ত এই সংগীতশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছে ‘বিনোদন’। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজমুল হক
সিনেমার গান নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে, বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
প্রীতম হাসান: এখন আমাদের ১০-১৫ কোটি টাকা বাজেটের সিনেমা হচ্ছে। গত দু–তিন বছর আগে এমন বড় বাজেটের ছবি কেউ চিন্তা করতে পারত? কিন্তু লাস্ট এক–দেড় বছর দেখেন, কত বড় বড় বাজেটের সিনেমা হচ্ছে। সেগুলো ভালো ব্যবসাও করছে। এটা খুবই ইতিবাচক। সিনেমার বাজেট বাড়লে মিউজিকের বাজেটও বাড়বে। তখন মিউজিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজনও ভালো পারিশ্রমিক পাবেন। ভালো একটা কাজের সুফল পুরো ইন্ডাস্ট্রি ভোগ করবে। দক্ষিণ ভারতেই দেখেন অনিরুদ্ধ রবিচন্দরকে, তাঁর শিডিউলের ওপর অনেক নির্মাতা সিনেমার পরিকল্পনা করেন।
আমরা ঠিক কোথায় পিছিয়ে আছি?
প্রীতম হাসান: নিজস্বতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিজেদের বাদ্যযন্ত্রীদের গুরুত্ব ও পর্যাপ্ত সাপোর্ট দিতে হবে। তাদের যত্ন করতে হবে যেন তারা রেগুলার সেশনে বাজায়। এ জিনিসটা ফিরিয়ে আনতে হবে। একটা সিনেমা কিন্তু শুধু সিনেমাই নয়, একটা সিনেমা যেমন একটা দেশের নায়ককে মহানায়ক বানাতে পারে, আবার একটা ইন্ডাস্ট্রিকেও ঘুরিয়ে দিতে পারে। আবার একটা গানও একটা সিনেমাকে হিট করে দিতে পারে। আমার বাবার আমলে যাঁরা সিনিয়র ছিলেন, তাঁরা সেশন মিউজিশিয়ানদের নিয়ে কাজ করতেন, যেটা ছাড়া এখনো পাশের দেশে কাজ হয় না। সেশন স্ট্রিম করেন একজন, অ্যারেঞ্জ করেন একজন, কম্পোজ করেন একজন, সুর করেন আরেকজন, লেখেন আরেকজন—এতে কাজের বাজেট হয়তো বাড়ে, কাজের মানও কিন্তু বেশ ভালো হয়। এটা যদি ফেরানো যায়, আমরা আবার একটা ডিফারেন্ট ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারব। একটু সময় লাগবে হয়তো, তবে একটা ভালো ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে। ভালো একটা কাজের সুফল কিন্তু পুরো ইন্ডাস্ট্রি ভোগ করে।
বাবা খালিদ হাসান মিলুর ভক্তরাও আপনার গান শুনে প্রশংসা করছেন...
প্রীতম হাসান: আমার কাছে মনে হয়, এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমার বাবার গান যাঁরা শোনেন, তাঁদের অনেকেই আছেন হয়তো আমার গান পছন্দ করেন না। আবার অনেকেই আছেন অনেক পছন্দ করেন। আমার বাবা, ভাই, আমি—মিউজিশিয়ান পরিবার, আমরা সব সময় একটা জিনিসই করি, কঠোর পরিশ্রম। অনেকেই বলেন যে এটা বংশগত, অমুক–তমুক, কিন্তু এমন কিছুই নয়। অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হয়েছে। আর আমি আরও কষ্ট করতে চাই। বিশেষ করে বাংলা সিনেমাকে অনেক কিছু দিতে চাই।
‘লাগে উরাধুরা’ বিশ্ব ট্রেন্ডিংয়ে জায়গা পেয়েছিল। এ ধরনের স্বীকৃতি কতটা অনুপ্রাণিত করে?
প্রীতম হাসান: সিনেমার গান দিয়েই বিশ্ব মানচিত্রে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। যেমন গত বছর ‘লাগে উরাধুরা’ গ্লোবাল ট্রেন্ডিংয়ে ৪ নম্বরে চলে আসে। সাবরিনা কার্পেন্টার থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় শিল্পীর গানকে আমরা টপকে গিয়েছিলাম। চিন্তা করেন, ছোট্ট একটা দেশ, অনেক সীমাবদ্ধতা, এরপরও সেরা পাঁচে। আমার কাছে মনে হয়, সবাই মিলে যদি সিনেমার মিউজিকে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিতে পারি, তবে আরও বড় কিছু হবে। আর বিশেষ করে আমি মনে করি, আগামী তিন–চার বছর বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বমঞ্চে টিকে থাকতে হলে আমাদের জরুরি কী করতে হবে বলে মনে করেন?
প্রীতম হাসান: আমাদের একটা সিস্টেমের ভেতর আসতে হবে। এমন কিছু করতে হবে, যাতে করে আমরা শিল্পীরা যেমন লাভবান হব, প্রযোজকেরাও লাভবান হবেন, সব স্টেকহোল্ডারই লাভবান হবেন। আমি প্রথম দিন থেকেই রয়্যালটি ও রাইটস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কনসার্ন ছিলাম। সবশেষ বরবাদ সিনেমায় ‘দ্বিধা’ গানের ক্ষেত্রেও প্রযোজকদের সঙ্গে খুবই চমৎকার একটা চুক্তি আমার হয়েছিল। এটাতে আমার গানের মালিকানা ও স্বত্ব আছে, আমি তাদের গানটির লাইসেন্স দিয়েছি। চমৎকার একটা উইন উইন সিচুয়েশন। আমি মনে করি, এমন হলে গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, গীতিকার থেকে সবাই লাভবান হবেন। এটা ঠিক না হলে ইন্ডাস্ট্রি কখনো এগোবে না। কাউকে ঠকিয়ে জেতা যায় না।
অনেকেই আপনার মধ্যে হাবিবের প্রভাব দেখেন, আপনি নিজের মধ্যে কার প্রভাব দেখেন?
প্রীতম হাসান: দেখেন, হাবিব ভাই একজন গ্রেট মানুষ। উনি কোনো দিনও এটা বলে বেড়ান না যে আমিসহ অনেককেই তিনি উঠিয়েছেন। তাঁর ভেতর কোনো দিন একটা সেকেন্ডের জন্যও এটা দেখিনি যে এটা ফিল করিয়েছেন, ‘আমার প্রতি তোমার গ্রেটফুল থাকা উচিত।’ আমার মনে হয়, এটা বিধাতা থেকেই ঠিক করা, তাঁদের মতো মানুষেরা সম্মানিত হোন সব সময়। এ কারণেই কিন্তু হাবিব ভাইকে সবাই আইডল মানেন। এখনো কাজ করার সময় আমার মাথায় হাবিব ভাই, ফুয়াদ ভাই, অর্ণব ভাইয়ের কথা সবার আগে আসে। এ ছাড়া বালাম ভাই আর তাহসান ভাই তো আছেনই। আমি বিশেষ করে তিনজনকে খুব মানি, হাবিব ভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছি, ফুয়াদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় আর অর্ণব ভাইয়েরও সান্নিধ্যও পেয়েছি। এই তিনজন মানুষ অসাধারণ, কখনো নিজেদের অবদান স্বীকার করেন না।
গানের সঙ্গে আপনার অভিনয় নিয়েও আলোচনা হয়, কেমন লাগে?
প্রীতম হাসান: আমি টুকটাক মিউজিক ভিডিওতে তো অভিনয় করেছি। কথায় আছে না, গাইতে গাইতে গায়েন আর নাচতে নাচতে নায়ক (হাসি)। আমার অবস্থা এমনই, নাচতে নাচতে নায়ক হয়ে গেছি। মোটেও ফান করছি না। এর জন্য আমি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আমার নির্মাতাদের প্রতি। বিশেষ করে নুহাশ হুমায়ূন ও তানিম রহমান অংশু ভাই। অংশু ভাই আমাকে পর্দায় আনেন আর নুহাশের শর্টফিল্মে প্রথম সুযোগ পাই। এ ছাড়া আরও অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছি, সবশেষ শিহাব শাহীন ভাইয়ের অবদান তো আছেই। আরেকটা কাজের কথা বলব, নাজমুল নবীনের পরিচালনায় আড়াল, অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে কাজটা করতে। করার পর চিন্তা করলাম, এত কষ্ট করলাম কাজটায়! কী হবে? এরপর দেখলাম মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারে মনোনীত হলাম, সমালোচক বিভাগে পুরস্কারও পেলাম, ক্রিটিকদের থেকে পাওয়া সম্মাননা অনেক বড় কিছু। আমার জন্য এটা অনেক বড় একটা পাওয়া। আপনি পৃথিবীতে আর যা–ই বলেন না কেন, গুরুজনের আশীর্বাদ অনেক বড় কিছু।