
বিজয় দিবস উপলক্ষে ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে সংগীতশিল্পী সানিয়া সুলতানা লিজার গান ‘আমরা সবাই বাংলাদেশ’। গানটি প্রকাশ পেয়েছে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজেও। গানটি লিখেছেন কবির বকুল, সুর ইমন সাহার। গানটির নেপথ্যের গল্প ও লিজার ব্যস্ততা জেনেছেন নাজমুল হক।
মৌলিক দেশাত্ববোধক গানের সংখ্যা আপনার অনেক বেশি...
সানিয়া সুলতানা লিজা : অনেক ধরনের গান তো করি, তবে আমার ক্যারিয়ার যদি দেখেন, শুরু থেকেই দেশের গানের প্রতি একটু দুর্বলতা বেশি। আমার ইউটিউব চ্যানেলে আধুনিক যেমন আছে, মৌলিক দেশের গানও কিন্তু আছে। এটা আসলে আমার দেশের গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই। আমি ছোটবেলায় প্রথম স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম দেশের গান গেয়েই। আবার অনেকে আমাকে বলেছেন, আমার গলায় দেশের গান ভালো লাগে। এ জন্যই চেষ্টা করি একটু বেশি বেশি মৌলিক দেশের গান করার।
‘আমরা সবাই বাংলাদেশ’ গানটি তৈরির পটভূমি কী ছিল? এতে তরুণদের যুক্ত করার চিন্তাটা কীভাবে এল?
সানিয়া সুলতানা লিজা : একটু হুট করেই গানটি তৈরি হয়েছে, আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা করিনি। ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই বকুল (কবির) ভাইকে বললাম, বিজয় দিবস আসছে, একটা দেশের গান করি। বকুল ভাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। সুর করা, গান লেখা, কম্পোজিশনের পুরো দায়িত্বই আসলে উনি নেন, ফলে আমার কষ্ট একটু কমে যায়। এরপর ইমন সাহা দাদাকে যুক্ত করি। চেয়েছিলাম পুরো টিমই একসঙ্গে কাজ করি যেন আমাদের মধ্যে যে একটা ভালো সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে, সেটাই পিকচারাইজেশন হোক। এ গানে আমার সঙ্গে ছয়জন তরুণ সংগীতশিল্পী রয়েছেন। তাঁরা সবাই ‘ইয়াং স্টার’ প্রতিযোগিতা থেকে উঠে এসেছেন। ২০২৩ সালে এর বিচারকাজে আমি, গীতিকার কবির বকুল ভাই আর সুরকার ইমন সাহা দাদা ছিলাম। তখন বেশ ভালো ভালো কণ্ঠ পেয়েছিলাম। তখন থেকেই আমার একটা চিন্তা ছিল, তাঁদের নিয়ে একটা কাজ করব। সেই থেকেই তাঁদের যুক্ত করা।
এখন গান বাছাইয়ে বাণিজ্যিক ভাবনাটা যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, সেই জায়গা থেকে দেশের গান নির্বাচন কি শুধু শিল্পীসত্তা ও ভালোবাসা থেকে?
সানিয়া সুলতানা লিজা : বাণিজ্যিকভাবে কোনো কিছুই চিন্তা করি না। এখন পর্যন্ত আমার যে গানগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সব স্রোতের বিপরীতে যাওয়া গান। সেসব থেকে কিন্তু আমার লাখ লাখ টাকা আয় হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে দেশের গানগুলো থেকেও এ রকম বাণিজ্যিকভাবে ও রকম কিছু রেভিনিউ আসে না। আমি এটা করি একমাত্র ভালোবাসা থেকেই। আমার ইউটিউব চ্যানেলটায় আমি শুধু আমার ভালো লাগে, এ রকম গানই দিই। একদম কমার্শিয়াল গান বা ফরমায়েশি গান—ওই রকম কনটেন্ট নিই না। বাণিজ্য নিয়ে ভাবি না, ভালো লাগার জন্য গান করি।
১৭ বছর আগে রিয়েলিটি শো দিয়ে এসেছিলেন। এখন আপনিই রিয়েলিটি শোর বিচারক। আপনার সময়কার প্রতিযোগী আর বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে প্রধান পার্থক্য কী দেখেন?
সানিয়া সুলতানা লিজা : একটা বড় পার্থক্য আছে। বড়দের প্রতিযোগিতায় যেটা দেখলাম, আমরা যখন ২০০৮ সালে প্রতিযোগী ছিলাম বা এর আগে যাঁরা ছিলেন, তখন একদম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো, সবাই অনেক ভালো গাইত, সবাই পারফেক্ট। এর মধ্য থেকে সেরা ১০ বের করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন হয়েছে কি, আমাদের পারফেক্ট ভয়েস খুঁজে পেতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। একটা বা দুইটা ভালো ছেলে–মেয়ে আসে, কিন্তু তাদের সঙ্গে বাকিদের বিশাল ফারাক। এমন কেন হচ্ছে আমি জানি না, তবে মনে করছি, আমাদের আসলে শেখার সুযোগটা কমে গেছে। গান তো আসলে একটা গুরুমুখী বিদ্যা, তো আমাদের ওই শেখার জায়গাটা মনে হচ্ছে নেই বলতে গেলে।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে খুব দ্রুত তারকাখ্যাতি, অনুসারী পাওয়া—এগুলো নিয়ে খুব আগ্রহ দেখা যায়। গান শেখার আগ্রহের চেয়ে দ্রুত সফল হওয়ার দিকেই কি তাদের নজর?
সানিয়া সুলতানা লিজা : এটা আসলে মানুষের স্বভাবগতই একটা বিষয়, সবাই আসলে তাড়াতাড়ি সবকিছু পেতে চায়। আমরা যে সময়টায় ছিলাম, তখনো কিন্তু এটা ছিল। শিল্পীদের যেটা একটু রয়ে (ধৈর্য) করতে হয়, এটা আমি এখনো মনে করি। রিয়েলিটি শো থেকে বের হওয়ার পর স্ট্রাগলটা শুরু হয়। এই জায়গায় ধৈর্য ধরাটা অনেক বেশি দরকার। আমাদের বাচ্চাদের এই জিনিসটা আসলেই শিখতে হবে। এখনই আমার মাসে ১০টা শো করতে হবে বা এখনই আমার হিট গান হতে হবে, না হলে হবে না, গান–টান করব না; এ রকম হলে আসলে হবে না।
ক্যারিয়ারের শুরুতেই প্লেব্যাকে পাওয়া গেছে আপনাকে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেমন আর পাওয়া যায়নি। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
সানিয়া সুলতানা লিজা : এখানে আমি আমার ভাগ্যকে দোষারোপ করব। যখন আমি শুরু করেছিলাম, তখন বাংলা সিনেমার একটা ভঙ্গুর সময় যাচ্ছিল। এখন যেমন এত বড় বড় বাজেটের সিনেমা হচ্ছে, মানুষ আবার হলমুখী হচ্ছে, সে সময়টা কিন্তু পাইনি। তাই হয়তো আমার কাজগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। আলোচনার সঙ্গে তো মার্কেটিংও জড়িত, এখনকার মতো তখন গান নিয়ে আলাদা করে এত প্রচার-প্রচারণাও হতো না। তবে আমি সব সময় ধৈর্য ধরেছি, তখনো, এখনো, সামনের দিনগুলোতেও। কোনো কিছু নিয়েই আমি হতাশ নই। অন্য শিল্পীদের মতো আমার জনপ্রিয় গান নেই, যা দিয়েই কেউ লিজাকে চিনে নিতে পারে। তবে এসব নিয়ে আমার একটাই কথা, ধৈর্য, ধৈর্য এবং ধৈর্য।
গত বছর মা হয়েছেন, জীবনে কি পরিবর্তন এসেছে?
সানিয়া সুলতানা লিজা : আমার না, আমার মায়ের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। আগে আমাকে সামলাতেন, এখন আমার বাচ্চাকেও সামলান। তাই এসব আমার ওপর দিয়ে যায় না, মা সব সামলাচ্ছেন। তবে মেয়ে যখন আমার কাছে থাকে, তখন কেউ নিতেই পারে না। আর এ সময় বেশি করে মনে হচ্ছে, শৈশবে আমাদের জন্য মা–বাবা কত কষ্ট করেছেন।
একসময় ব্যাডমিন্টনে অনেক নাম করেছিলেন, এখন তো গান আর সংসার নিয়ে ব্যস্ততা। খেলা কি একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন?
সানিয়া সুলতানা লিজা : এখনো কোনো কনসার্টে গেলে ব্যাডমিন্টন কোর্ট দেখলে লোভ সামলাতে পারি না। ছোটবেলায় তো গান আর খেলা একসঙ্গে চলত। মনে পড়ে, গানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে কষ্ট পেতাম না। কিন্তু যদি খেলায় হারতাম, সারা দিন কান্না করতাম। কোনো কিছু দিয়ে কেউ আমার মন ভালো করতে পারত না। খেলা ছাড়ার পর একটা কষ্ট আছে, তবে বয়স তো হলো (হাসি)। অবসর নিয়ে নিলাম তাই।