নকীব খান
নকীব খান

এখনো মনে হয়, আমার শ্রেষ্ঠ কাজটা করতে পারিনি: নকীব খান

২০২৪ সালেই সুরকারজীবনের ৫০ বছর পূর্ণ করেছেন নকীব খান। অর্ধশতক পূর্তি উপলক্ষে আজ শুক্রবার ঢাকার তেজগাঁওয়ের ইয়ামাহা ফ্ল্যাগশিপে গাইবেন তিনি। জানা যাবে তাঁর জীবনের আরও নানা গল্প। ৫০ বছরের পথচলা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

সুর–সংগীতে ৫০ বছর। প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

নকীব খান : সবচেয়ে বড় প্রশান্তি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই প্রাপ্তি হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে। তবে সৃষ্টিতে খুশি কি না, এটা যদি জানতে চাওয়া হয়, তাহলে বলব, আমি মোটেও খুশি নই। আরও অনেক কিছু করার বাকি। এখনো মনে হয়, আমার শ্রেষ্ঠ কাজটা করতে পারিনি। মনে হয়, কিছুই করতে পারিনি।

প্রশ্ন

আপনার একাধিক গান তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মনে গেঁথে আছে। তারপরও কেন মনে হলো শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিটি এখনো সম্ভব হয়নি?

নকীব খান : সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি যদি হয়ে যায়, তাহলে আর কিছুই তো করার থাকে না। তখন হতাশায় ভুগব। আমার কাছে এখনো মনে হয়, অনেক কিছু বাকি। সংগীত তো একটা বিশাল মহাসমুদ্র, সেখান থেকে আমরা শুধু একটা নুড়ি কুড়িয়েছি। আর কিছুই না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সঙ্গে তুলনা করলে তো আরও কিছুই না।

প্রশ্ন

বেশির ভাগ মানুষ আপনাকে শিল্পী হিসেবে চেনেন। তবে শিল্পীরা আপনাকে অসাধারণ একজন সুরকার হিসেবেও চেনেন। শিল্পী, নাকি সুরকার—কোন পরিচয় বেশি উপভোগ করেন?

নকীব খান : সুরকার পরিচয়টাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। গান গাওয়াটা হচ্ছে শুধুই পারফর্ম করা। আমি যেটা যেটা লিখছি বা সুর করছি, সেখানে নতুন কিছু একটা সৃষ্টি হচ্ছে। সৃষ্টি তাই আমার কাছে বেশি আনন্দের, উপভোগের।

প্রশ্ন

যত গান আপনি সুর করেছেন, সেগুলো যাঁরাই গেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কার সঙ্গে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন?

নকীব খান : এমনিতেই আমি একটু নিজের পছন্দে চলি। আমি যে গান সুর করি, সেটা কার কণ্ঠে মানাবে, তা নিয়ে দোটানায় থাকি। যাঁর কণ্ঠে পারফেকশন আসবে, তাঁকে দিয়েই গাওয়াই। সে হিসেবে বলব, যাঁরা আমার সুরে গেয়েছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’, এটা তো (ফয়সাল সিদ্দিকী) বগি ভাই গেয়েছেন, যিনি জীবনে কোনো দিন তার আগে বাংলা গান গাননি। ওটাই তাঁর গাওয়া প্রথম বাংলা গান। গানটা তো আমিও গাইতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনিই সবচেয়ে ভালো গাইতে পারবেন। এই গানটা নীলুফার ইয়াসমীন আপা গেয়েছেন, তিনি দারুণ গেয়েছেন।

নকীব খান
প্রশ্ন

৫০ বছরে অনেক গানই করেছেন। এমনটা কি হয়েছে, গান তৈরি করেও প্রকাশ করতে পারেননি?

নকীব খান : অনেক গান আমি সুর করেছি। কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি। কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়। আগে যেমন মিউজিশিয়ান নিয়ে একটা গান রেকর্ড করতে গেলে কিছু খরচ হতো। এখন তো তা অনেক ব্যয়বহুল। সাধারণত আগে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গান তৈরির খরচ বহন করত। আমাদের দেশে হয়েছে কী, ওই ব্যাপারগুলো ঠিকমতো পাই না। যার ফলে অনেক ক্রিয়েশন মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এটা আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট।

প্রশ্ন

এখনো আমার সুর করা শ খানেক গান পড়ে আছে, বিকজ অব ফাইন্যান্সিয়াল ইস্যু।
এই প্রবণতা কবে থেকে?

নকীব খান : ইদানীং এমনটা বেশি হচ্ছে। আগেও যে একদম হয়নি, তা কিন্তু না। এখন ভিউ দিয়ে গানের বিচার করছে। ভালো মানের গানের যেন তাদের কাছে কদর কম। আমার কাছে মনে হয়, তাদের বোঝারও অভাব রয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এটা বুঝতে হবে, গানটা কিন্তু অডিও, ভিডিও না। আরেকটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ভালো মানের গানের কদর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যাবে না, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভালো গানটাই টিকে থাকবে। স্থায়ী হবে। ব্যবসায়ীরা শর্ট টার্ম লাভ খোঁজে, যেটা সত্যিই কষ্টকর।

প্রশ্ন

৫০ বছর পেরিয়ে সংগীতজীবনের শুরুর দিকে তাকালে কোন ঘটনাগুলো বেশি মনে পড়ে?

নকীব খান : বড় ভাইদের ‘বালার্ক’ নামে একটা ব্যান্ড ছিল। ওটা যখন ভেঙে যায়, তখন সোলসে যোগ দিই। শুরুতে সোলসের নাম ছিল ‘সুরেলা’। সোলস তখন মৌলিক গান করত না। কাভার গানই বেশি হতো, লোকগানও করত। আমি সোলসে ঢুকেই প্রথম মৌলিক গান, নতুন গান তৈরির চেষ্টা করি। আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, নিজস্ব গান যদি না থাকে, নিজস্বতা তৈরি হবে না। পরিচিতি বাড়বে না। তাই মৌলিক গানের ওপরই জোর দিয়েছি। সোলসের অন্য সদস্যদেরও বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তারা তখন বুঝতে চাইত না। ভাবত, মানুষ তো স্টেজে শুনবে না নতুন গান। তখন বলতাম, আরে ভাই, আজকে না হয় শুনবে না, কিন্তু একদিন তো ঠিকই শুনবে। গাইতে হবে বেশি বেশি। গাইতে গাইতে মানুষের মাথায় গান ঢুকবে। তাই শোনাতে হবে জোর করে। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’—এই গানগুলো একরকম জোর করে মঞ্চে শোনানো হতো।

প্রশ্ন

সুরকার ও সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে আপনার ওপর কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি?

নকীব খান : গায়ক হিসেবে নিজেকে কখনো চিন্তা করিনি। প্রথমে কি-বোর্ড বাজাতাম। তারপর সুর করা শুরু করলাম। ওটাতেই আমি আনন্দ পেতাম। কখনো ভাবিনি গায়ক হব। তবে গান তো গাইতাম। যেহেতু সোলসে তপন চৌধুরী ও তাজুল ইমাম ভাই প্রধান গায়ক। তাঁদের দিয়েও আমার সুরে গান গাওয়াতাম। কিন্তু আমি কখনো গাইতে চাইতাম না। একটা ঘটনার কথা বলি। আমরা যেহেতু চট্টগ্রামে থাকতাম, ঢাকায় শো করা হতো না। ১৯৭৬ সালের পর নিয়মিত আসা শুরু করি। ঢাকা মেডিকেল আমাদের প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাত, যেহেতু ডা. আরিফ (সোলসে গান লিখতেন) ওখানে পড়ত। এ রকম একটা শোতে হঠাৎ করে তপন অসুস্থ হয়ে যায়। উপায় না দেখে গাইতে হলো। সেদিন থেকে গায়ক হয়ে গেলাম। তার আগপর্যন্ত ব্যান্ডের জন্য স্টেজে গাইব ভাবিনি। এর পর থেকে নিয়মিত গাইতাম। সুরকার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিলেন আমার বড় ভাই জিলু খান। ওনার অনেকগুলো গান আমি সুর করতাম। আমাদের তিন ভাইয়ের যে ব্যান্ড ছিল, সেখানে ওনার গানই করতাম। ‘দরগায় মন দিলে কী হবে’, ‘মনে করো এখন অনেক রাত’—এই গানগুলো ভাইয়ার সুরের।

পিলু খান, জিলু খান ও নকীব খান
প্রশ্ন

কী সেই ঘটনা?

নকীব খান : ১৯৭৪ সাল, তখন চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট স্কুলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই সময়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে জীবনের প্রথম গানের সুর করি। আমার বড় ভাই জিলু খান (জালাল উদ্দিন খান জিলু) ও হেনা (ইসলাম) ভাই বন্ধু ছিলেন। ভাইয়াকে তখন হেনা ভাই সুর করার জন্য কয়েকটা লিরিক দিয়েছিলেন। বড় ভাই এসব লিরিক ড্রয়ারে রেখেছিলেন। তিনি যখন বাসার বাইরে যান, অফিসে গেলেন—তখন মনে মনে ভাবলাম, আমি একটা সুর করার চেষ্টা করে দেখি না। ড্রয়ার থেকে ঝুঁকি নিয়ে চুরি করে একটা লিরিক নিলাম, এরপর সুর করলাম। বড় ভাই বাসায় আসার পর বললাম, একটা অন্যায় কাজ করছি। ড্রয়ার থেকে আপনার একটা গান চুরি করে নিয়ে সুর করছি। এরপর বড় ভাই বললেন, ‘তাই নাকি! তাই নাকি! কই দেখি, শোনাও তো।’ শোনানোর পর আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘অনেক দোয়া করি, খুব ভালো হয়েছে গানটা।’ এভাবেই আমার সুরকার হিসেবে পথচলা শুরু।

প্রশ্ন

এখন তো সংগীত ইন্ডাস্ট্রির বড় একটা বদল হয়ে গেছে, নতুন শিল্পীরা নিজের মতো করে গান তৈরি করে নিজেরাই প্রকাশ করছেন। পুরো বদলটা কীভাবে দেখেন?

নকীব খান : যুগের সঙ্গে সঙ্গে এমনটা হয়। পরিবর্তন হয়। সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, স্টার হওয়া খুব সোজা। সত্যিকার অর্থে শিল্পী হওয়া, দীর্ঘ সময় মানুষের মনে বেঁচে থাকা কঠিন ব্যাপার। শিল্পী হওয়ার জন্য সাধনা করতে হবে, কষ্ট করতে হয়। সেই সাধনা যাঁর মধ্যে থাকবে না, সে কখনোই স্থায়ী হবে না। এখনকার যারা কম্পোজ করছে, তারা বেশিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর। যেটা হয় কী, ওরা প্রযুক্তির দাস হয়ে গেছে। উল্টো হওয়া উচিত, প্রযুক্তিকে তাদের দাস বানাতে হবে। নিজস্ব যে সৃজনশীলতা আছে, এটাকে বেজ করে প্রযুক্তির টুলস ব্যবহার করবে। মাথায় রাখতে হবে—শর্টকাট বলে কিছু নাই, স্টার হওয়া সোজা, শিল্পী হওয়া কঠিন।’

প্রশ্ন

নিজের গাওয়া বা সুরকার করা পছন্দের ৫ গানের কথা বললে কোন গানগুলোর কথা বলবেন?

নকীব খান : এটা বলা খুবই ডিফিকাল্ট। প্রতিটি গানই আমার কাছে সন্তানের মতো। প্রিয় গানের কথা দর্শক–শ্রোতারাই বলবেন, কোনটা ভালো।

প্রশ্ন

তাহলে যদি বলি, ঠিক এ মুহূর্তে আপনার গাওয়া ও সুর করা কোন গানগুলোর কথা মনে পড়ছে?

নকীব খান : সোলসের ‘নদী এসে পথ’, রেনেসাঁর ‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’, ‘ভালো লাগে জোছনা রাতে’, ‘ও নদী রে’, ‘আচ্ছা কেন মানুষগুলো’, ‘তুমি কি আজ বন্ধু’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’—এগুলো মনে হয়। আর যদি লেখার কথা বলি, প্রথমেই মনে হয়, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’।

নকীব খান
প্রশ্ন

আজকের আয়োজনে কোন গানগুলো গাইবেন?

নকীব খান : দেড় ঘণ্টার মতো গাইব। চেষ্টা করব, দর্শক–শ্রোতাদের যে গানগুলো পছন্দ, সেগুলো গাওয়ার। তাৎক্ষণিক অনুরোধ রাখার চেষ্টাও করব। পাশাপাশি এদিন কথাবার্তাও শুনব। আমার বড় ভাইও সেদিন থাকবেন। বগি ভাইও থাকবেন।

প্রশ্ন

আলাপের শুরুর দিকে বলছিলেন, আপনার সুরের শ খানেক গান অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এগুলো প্রকাশ করতে চান। এর বাইরে এমন কোনো কিছু করার স্বপ্ন দেখেন?

নকীব খান : আমি কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করিনি। দুটি গান করেছিলাম একটা সিনেমার জন্য, মিক্সড মাস্টারও হয়ে গেছে। শুধু শুটিং হয়নি। ছবিটির কাজ আদৌ হবে কি না, বলতে পারছি না। তবে সিনেমায় কাজ করার ক্ষেত্রে আমাকে স্বাধীনতাও দিতে হবে, না হলে কাজ করে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করার একটা স্বপ্ন রয়েছে। যেমনটা এ আর রাহমান হলিউডে করেছেন। ব্যাপারটা ঠিক ওটার মতো নয়, আমরা তো আর এ আর রাহমানের মতো সুযোগ-সুবিধা পাব না, তারপরও যতটুকু সম্ভব আরকি।

প্রশ্ন

আপনার সুরে এখনকার প্রজন্মের কাউকে দিয়ে গান গাওয়ানোর কোনো ইচ্ছা আছে?

নকীব খান : আমি সব সময় চাই, নতুনেরা আসুক। আমার শুরুটা যখন হয়েছিল তখন তপন চৌধুরী, সামিনা, ফাহমিদা নবীরা নতুনই ছিল। কুমার বিশ্বজিতেরও প্রথম গান আমার করা। আমি সব সময় নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। প্রশ্নটা হচ্ছে, শুধু নতুন হলে তো হবে না, আমার গানের গায়কিটা যারা ঠিকঠাকভাবে করতে পারবে, তাদের নিয়ে অবশ্যই কাজ করব। আমাদের অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছে, তাদের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। বেশি বেশি কাজ করতে হবে। তাদের ঠিকমতো ইউটিলাইজড করতে পারিনি আমরা।