
২০২৫ সালে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে নির্মাতাদের গল্প বলা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। গতানুগতিক বিনোদনের বাইরে গিয়ে নির্মাতারা গল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন সমসাময়িক রাজনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক অবক্ষয় আর মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বকে। বিশেষ করে বড় পর্দার আলোচিত নির্মাতা আর তুখোড় চিত্রনাট্যকারদের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে পদচারণ—ছোট পর্দার গুণগত মানকে সিনেমাটিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে; সিরিজগুলোকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত রহস্যের জট—সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ছিল গল্পের বৈচিত্র্যে ভরপুর একটি বছর। নির্মাণশৈলী, চিত্রনাট্যের বুনন ও পারফরম্যান্সের বিচারে বিবিসি চলতি বছরের সেরা সিরিজগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে জেনে নেওয়া যাক সেরা ১৫টি সিরিজের কথা।
১. ‘দ্য লোডাউন’, এফএক্স
‘রিজার্ভেশন ডগস’ বানিয়ে চমকে দিয়েছিলেন স্টের্লিন হারজো। মার্কিন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এই নির্মাতার কাছে উঠে আসে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় সব গল্প। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো কাহিনিকে বাস্তব আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। আর ইথান হক চরিত্রের প্রয়োজনে আমূল বদলাতে পারেন নিজেকে। এই দুইয়ের রসায়নে ওকলাহোমার তুলসা শহরকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য লোডাউন’।
যেখানে ইথান হক অভিনয় করেছেন ‘লি রেইবনের’ চরিত্রে, যে এমননিতে প্রাণবন্ত; কিন্তু একটু জটিল স্বভাবের। রেইবনের জীবন অগোছালো। পুরোনো বইয়ের দোকানের ওপরের একটি ঘরে তাঁর বসবাস। কিন্তু খণ্ডকালীন সাংবাদিক হিসেবে তিনি আপসহীন। প্রভাবশালী ওয়াশবার্ন পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন সহিংসতা ও খুনের জালে।
সাংবাদিকতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমি দখলের মতো বিষয়গুলো এখানে দারুণভাবে উঠে এসেছে। বিপদে ঘিরে থাকা রেইবন চরিত্রে ইথান হকের আদর্শ ও রসবোধ সিরিজটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
‘দ্য লোডাউন’একটি দ্রুতগতির রাজনৈতিক ড্রামা। এর সমসাময়িক রাজনৈতিক পটভূমি আর ধারালো সংলাপ আপনাকে প্রতিটি মুহূর্তে ভাবিয়ে তুলবে। যারা ‘দ্য নিউজরুল’বা ‘সাকসেশন’-এর মতো সিরিজ পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে দারুণ উপভোগ্য সিরিজ।
২. ‘এলিয়েন: আর্থ’, হুলু
ডিজনির ‘স্টার ওয়ার্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজির জনপ্রিয়তার পড়তি দেখে অনেকেরই মনে সংশয় ছিল, বড় বাজেটের সিনেমাকে ছোট পর্দায় আনলে তার আবেদন থাকবে কি না। কিন্তু ‘ফার্গো’ নির্মাতা নোয়া হাওলি সেই সংশয় উড়িয়ে দিয়েছেন এই আট পর্বের সিরিজে।
একটি মহাকাশযানের বিধ্বস্ত হওয়া এবং এক নতুন জাতের ‘সিন্থেটিক’ অতিমানব তৈরির গল্প নিয়ে নির্মিত ‘এলিয়েন: আর্থ’ সিরিজটি। ভিনগৃহবাসীদের নিয়ে সিনেমা-সিরিজ হয়তো দেখেছেন অনেক, কিন্তু এত বড় পরিসরে যে দেখেননি তা এই সিরিজ দেখলেই বুঝতে পারবেন। এটি যেন ভয় আর রোমাঞ্চের এক নিখুঁত মিশ্রণ। বিশেষ করে সিরিজের একটি বিশেষ পর্বকে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বলে ভুল হয়। দারুণ এক রহস্য রেখে এবারের মৌসুমটি শেষ হয়েছে। তবে দর্শকদের জন্য সুখবর, ২০২৭ সালেই আসছে এর দ্বিতীয় কিস্তি।
৩. ‘মিস্টার স্করসেসি’, অ্যাপল টিভি
নিজের কাজ নিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে খুব কম নির্মাতাই পারেন। তবে ব্যতিক্রম মার্টিন স্করসেসির। প্রখ্যাত এই মার্কিন নির্মাতাকে নিয়ে রেবেকা মিলারের প্রামাণ্যচিত্রটি তাঁকে যেন সেই সুযোগই করে দিয়েছে।
ধর্ম থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, ক্যারিয়ার—সবকিছু নিয়েই এখানে অকপট স্করসেসি। মিলার সিরিজে স্করসেসির শৈশব, তাঁর পরিবার ও লিটল ইতালিপাড়ার এমন কিছু দুর্লভ ফুটেজ ও ছবি ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর ১৯৭৩ সালের কালজয়ী সিনেমা ‘মিন স্ট্রিটসের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। রবার্ট ডি নিরো কিংবা ইসাবেলা রোসেলিনির মতো সহকর্মীদের সাক্ষাৎকার এই প্রামাণ্যচিত্রকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এই সময়ের অন্যতম সেরা নির্মাতাদের একজনকে নিয়ে নির্মিত সিরিজটি এতটাই তথ্যবহুল ও আকর্ষণীয় যে দেখার পর মনে হতে পারে এটি আরও দীর্ঘ হলেও মন্দ হতো না। তথ্যচিত্র হলেও এর ভিজ্যুয়াল ও সিনেমাটোগ্রাফি সিনেমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যারা ইতিহাস ও দর্শন পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি একটি ‘মাস্ট ওয়াচ।’
৪. ‘প্লুরিবাস’, অ্যাপল টিভি
‘ব্রেকিং ব্যাড’ আর ‘বেটার কল সলের’ আকাশচুম্বী সাফল্যের পর ভিন্স গিলিগান যা নিয়ে এলেন, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। অপরাধজগতের গল্প ছেড়ে একেবারে সায়েন্স ফিকশন জগতে নিজের জাত চেনালেন।
‘প্লুরিবাস’ সিরিজটি নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্ক শহরকে পটভূমিতে নির্মিত। এই সায়েন্স ফিকশনটিতে সমাজ নিয়ে এক গভীর বার্তা দেয়। রিয়া সিহরন এখানে ‘ক্যারল’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। গল্পে দেখা যায়, এক ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সব মানুষ সব সময় সুখী থাকে, কিন্তু তাদের সবার চিন্তাভাবনা এক হয়ে গেছে।
ব্যক্তিগত স্বকীয়তার কোনো জায়গা নেই। যেন এক স্বৈরাচারী সরকারের কারসাজি!
ক্যারল কীভাবে এই ছক থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে চান, সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি নিয়ে এগিয়েছে সিরিজটি। জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’-তে যে সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন, এ সিরিজে তারই একটি দার্শনিক শিল্পরূপ দেখা যায়। সিরিজটি প্রমাণ করে যে সায়েন্স ফিকশনও কতটা সমসাময়িক ও শিল্পগুণসম্পন্ন হতে পারে।
৫. ‘ব্লু লাইটস’, বিবিসি ওয়ান
বেলফাস্টের পটভূমিতে তৈরি ‘ব্লু লাইট’ সিরিজটি পুলিশের জগতের রহস্যকে সামনে নিয়ে আসে। এই পুলিশ ড্রামাটি চলতি বছর বাফটা পুরস্কারও জিতেছে। তিন মৌসুম ধরে সিরিজটি ছোট পর্দার অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় সিরিজের মর্যাদা পেয়েছে।
অপরাধজগতের কালো দিককে এখানে খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার আবহে তৈরি সিরিজটি। এতে প্রাণ দিয়েছেন চরিত্রগুলোর অভিনয়শিল্পীরা। বিশেষ করে সাবেক সমাজকর্মী থেকে পুলিশ হওয়া ‘গ্রেস’ চরিত্রে সিয়ান ব্রুকের অভিনয় দারুণ।
এবারের মৌসুমে অপরাধজগতের দুই নারী নেত্রীর চরিত্রে আবিগেইল ম্যাকগিবিন ও ক্যাথি টাইসন ছিলেন দুর্দান্ত। ‘ব্লু লাইটস’ কেবল একটি ক্রাইম শো নয়। একে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার এক শক্তিশালী দলিলও বলা চলে।
৬. ‘দ্য গার্লফ্রেন্ড’, অ্যামাজন প্রাইম
‘বিগ লিটল লাইজের’ সাফল্যের পর ধনীদের অন্ধকার জগতের রহস্য নিয়ে একের পর এক থ্রিলার বানানো হচ্ছে। তবে প্রাইম ভিডিওর সিরিজটি তার নাটকীয় উপস্থাপনার কারণে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চোখে পড়ে।
ব্রিটিশ লেখক মিশেল ফ্রান্সিসের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিরিজে অভিনয় করেছেন রবিন রাইট। তিনি এখানে এক আর্ট গ্যালারির মালিক, যার সঙ্গে তার ছেলের সম্পর্কটা একটু বেশিই জটিল। গল্প শুরু হয় এক মা ও ছেলের প্রেমিকার মধ্যকার সন্দেহ ও টানাপোড়েন নিয়ে। মা মনে করেন, তার ছেলের নতুন প্রেমিকা আসলে যা দেখাচ্ছে তা নয়, তার পেছনে রয়েছে কোনো ভয়ংকর উদ্দেশ্য।
রহস্যময়ী প্রেমিকার চরিত্রে অলিভিয়া কুক দুর্দান্ত। আভিজাত্য আর বিলাসবহুল অন্দরমহলের আড়ালে দুই অভিনেত্রীর দাপুটে ক্ষমতার লড়াই দর্শককে পর্দার সামনে আটকে রাখে।
‘হাউস অব কার্ডসের’ মতো এখানেও রবিন রাইট তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়শৈলী দেখিয়েছেন। গল্পের মোড় মাঝেমধ্যে অবিশ্বাস্য মনে হলেও দুই প্রধান চরিত্রের অভিনয়ের লড়াই সেই খামতি পুষিয়ে দিয়েছে।
৭. ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’, নেটফ্লিক্স
‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ প্রখ্যাত ড্যানিশ ক্রাইম-থ্রিলার লেখক ইউসি অ্যালার-ওলসেনের বহুল পঠিত ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ সিরিজ থেকে নির্মিত। ‘নরডিক নোয়া’ উপন্যাস সিরিজটি থেকে ডেনমার্কে ছয়টি সিনেমা হয়েছে; এবার এসেছে সিরিজ। নরডিক নোয়ার গন্ধের সঙ্গে সিরিজটির ক্রিয়েটর স্কট ফ্র্যাঙ্ক আর চাঁদনি লাখানি জুড়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ হাস্যরস; সব মিলিয়ে ‘ডিপার্টমেন্ট কিউ’ হয়ে উঠেছে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো এক সিরিজ।
সিরিজের শুরুটাই হয় হত্যাকাণ্ড দিয়ে। ক্রাইম সিনে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন ডিটেকটিভ চিফ ইন্সপেক্টর কার্ল মর্ক (ম্যাথু গুড) আর টিম। আততায়ীর গুলিতে মারা যান এক পুলিশ সদস্য, কার্লের সহকারী জেমস (জেমি সিভস) পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কার্লের নিজেরও গলায় গুলি লাগে। অস্ত্রোপচার শেষে কাজে ফেরেন তিনি। তবে এ ঘটনা তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। এক সহকর্মীর মৃত্যু আর প্রিয় সহকারীর এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করেন কার্ল। পরে তিনি কাজে যোগ দেন ঠিক, তবে তাঁকে এমন বিভাগে বদলি করা হয়, যেখানে শুধু অমীমাংসিত বা পুরোনো কেসগুলো থাকে। বছরের পর বছর পড়ে থাকা রহস্যগুলোর জট তিনি এবং তার সহকারী মিলে খুলতে শুরু করেন।
অতীতের কোনো এক ঘটনার ট্রমা বয়ে বেড়ানো খিটখিটে গোয়েন্দা চরিত্র এখন অনেকটা ক্লিশে। কিন্তু ‘ডেপ্ট কিউ’-তে ম্যাথিউ গুড তাঁর চরিত্রে গভীরতা ও তীক্ষ্ণ রসবোধের মধ্য দিয়ে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন।
সিরিজের নির্মাতা ‘দ্য কুইন্স গ্যাম্বিট’খ্যাত স্কট ফ্রাঙ্ক ও চাঁদনি লাখানি যেন ভালোভাবেই জানতেন, পুরোনো মামলার চেয়ে চরিত্রগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আকরাম সালিমের (আলেক্সেই মানভ্যালোভ) রহস্যময় অতীত ও সিরিয়া সংযোগ; কাহিনিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। সিরিজটি রোমাঞ্চকর দর্শকেরা দেখার তালিকায় রাখতে পারেন।
৮. ‘ডাইং ফর সেক্স’, হুলু
এক সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে এই ড্রামা সিরিজটি। আট পর্বের মিনি সিরিজটি মলি কোচান নামের এক নারীর অসাধারণ গল্প। স্তন ক্যানসারের চতুর্থ ধাপে থাকা মলি সিদ্ধান্ত নেন তাঁর স্বামীকে ছেড়ে দেবেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় নিজের শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা খুঁজে নিতে নতুনভাবে শুরু করবেন।
তবে ‘ডাইং ফর সেক্স’ সিরিজের সাথর্কতা এর পরিমিতবোধে। মিশেল উইলিয়ামস মলির চরিত্রে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত অভিনয় করেছেন। এটি কেবল যৌনতার কাহিনি নয়; বরং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক ভিন্ন, বিচিত্র প্রকাশ। সিরিজের শেষ দিকে মৃত্যুর যে চিত্রায়ন করেছেন নির্মাতা শ্যানন মার্ফি ও ক্রিস টিগ, তা দর্শকের চোখে জল আনতে বাধ্য করে। এবারের গোল্ডেন গ্লোবেও মনোনয়ন পেয়েছে আলোচিত সিরিজটি।
৯. ‘মিস্টার লাভারম্যান’, বিবিসি ওয়ান
বার্নার্ডিন এভারিস্টোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ড্রামা সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র ব্যারিংটন লাভারম্যান। সত্তরোর্ধ্ব ব্যারি একাধারে স্বামী, বাবা ও দাদা। বাইরে থেকে তাকে একজন সুখী বিবাহিত পুরুষ মনে হয়, তবে তাঁর রয়েছে একটি ৫০ বছরের গোপন সম্পর্ক! বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সত্য পরিচয় প্রকাশের সাহসিকতার গল্প এটি।
‘লাভারম্যান’ চরিত্রে অভিনেতা লেনি জেমস এখানে দেখিয়েছেন একটি প্রজন্মের মানুষের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার লড়াই আর দীর্ঘদিনের লুকানো প্রেমের টানাপোড়েন।
ব্যারির স্ত্রী কারমেল চরিত্রে শ্যারন ডি ক্লার্কের অভিনয় ছিল হৃদয়ছোঁয়া। দীর্ঘ ৫০ বছরের দাম্পত্যে এই গোপন সম্পর্ক যে ক্ষত তৈরি করেছে, সিরিজটি তা অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছে। এখানে কেউ-ই ভিলেন নয়; কিন্তু সমাজের নিয়ম ভেঙে নিজের সত্যকে গ্রহণ করার যে আকুতি, এ সিরিজটিতে অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে। সিরিজটির নির্মিতা হং খাউ।
১০. ‘দ্য স্টুডিও’, অ্যাপল টিভি
হলিউডকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে সিনেমা-সিরিজ বানানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু ‘দ্য স্টুডিও’এতটাই তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত যে একে বছরের সেরা কমেডি শো বলা যেতে পারে।
শেঠ রোগান অভিনীত এই সিরিজটি হলিউডের একটি মুভি স্টুডিওর ভেতরের বিশৃঙ্খল পরিবেশকে ঘিরে তৈরি।
একটি বড় স্টুডিও চালানো যে কতটা ঝামেলার কাজ, আর সিনেমা বানাতে গিয়ে সৃজনশীলতা ও ব্যবসার চাপে পড়ে মানুষ কত অদ্ভুত আচরণ করে, তা এখানে মজার ছলে দেখানো হয়েছে।
রন হাওয়ার্ড, অলিভিয়া ওয়াইল্ড থেকে শুরু করে মার্টিন স্করসেসির মতো তারকারা এখানে নিজেদের চরিত্রে অভিনয় করে হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছেন। পুরো চলচ্চিত্রশিল্প যখন সংকটের মুখে, তখন স্টুডিওর ভেতরে পর্দার আড়ালে আসলে কী চলে—সিরিজটি সেই চিত্রই তুলে ধরেছে।
শেঠ রোগান নিজস্ব স্টাইলের কমেডি ও হলিউডের ওপর তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ একে অনন্য করে তুলেছে। আপনি যদি সিনেমা তৈরির পেছনের গল্প নিয়ে আগ্রহী হন, তবে সিরিজটি আপনার জন্যই।
১১. ‘দ্য হোয়াইট লোটাস’, এইচবিও
ব্যয়বহুল রিসোর্ট, অবকাশযাপন, অনৈতিক ব্যাপারস্যাপার, সম্পর্কের গল্প নিয়ে ‘দ্য হোয়াইট লোটাস’। এইচবিও আর এইচবিও ম্যাক্সে ২০২১ সালে যখন সিরিজটির প্রথম মৌসুম মুক্তি পায়, তখনই ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বলা যায়, দুনিয়ার সব তরুণই সিরিজটিতে বুঁদ ছিলেন। ২০২২ সালে পরের মৌসুমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া তৃতীয় মৌসুমও প্রশংসিত হয়েছে।
সিরিজটির প্রতি মৌসুমে একটি নতুন বিলাসবহুল রিসোর্টে আসা ধনী পর্যটকদের জীবনের অন্ধকার আর অদ্ভুত দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। সিরিজের প্রথম মৌসুমের পটভূমি ছিল হাওয়াই, দ্বিতীয়টির সিসিলি। এবার থাইল্যান্ডে হাজির হয়েছেন নির্মাতারা। মাইক হোয়াইটের এই বিদ্রূপাত্মক সিরিজটি প্রথম দুই সিজনেই দর্শকদের মন জয় করেছিল। তবে তৃতীয় সিজনে এসে এটি যেন এক সাংস্কৃতিক উন্মাদনায় পরিণত হয়েছে।
থাইল্যান্ডের এক রিসোর্টে দুর্নীতিবাজ থেকে শুরু করে প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেমিক—বিচিত্র সব মানুষের সমাগম ঘটে। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত অহংকার, সম্পর্কের জটিলতা ও মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভণ্ডামি একসময় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
উচ্চবিত্ত সমাজের মানসিকতাকে এভাবে বিদ্রূপাত্মকভাবে সম্ভবত আর কোনো সিরিজে দেখানো হয়নি। জনপ্রিয় সব পর্যটনকেন্দ্রে শুটিং, সময়ের সঙ্গে যায় এমন সব বিষয়; তাই বোদ্ধা থেকে সাধারণ দর্শক, সবারই সিরিজটি পছন্দ। তবে এসব ছাপিয়েও বড় কারণ হলো, নির্মাতাদের বার্তা। কার্যত পুরো সিরিজেই পুঁজিবাদী সমাজ নিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন নির্মাতারা। আর গুরুগম্ভীর কোনো সংলাপ বা অতিনাটকীয়তা ছাড়াই ডার্ক কমেডির মোড়কে সেটা দেওয়া হয়েছে।
সিরিজটির এক এক পর্ব মুক্তির পর এই সিরিজ নিয়ে ইন্টারনেটে যে পরিমাণ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক চলেছে, তা ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ কেউ এই সিজনের ধীরগতি নিয়ে অভিযোগ করলেও সিরিজটির মূল শক্তি ছিল এর চরিত্রগুলোর গভীরতা। পার্কার পোসি ও কেরি কুনদের অনবদ্য অভিনয় সিরিজটিতে প্রাণ দিয়েছে। অনেকের মতে, গত দুই মৌসুমের তুলনায় এবারের তৃতীয় সিজন বেশি ভালো ছিল। থাইল্যান্ডের চমৎকার লোকেশন আর সিরিজের আইকনিক আবহ সংগীতও ছিল মুগ্ধ করার মতো।
১২. ‘অ্যাডোলেসেন্স’, নেটফ্লিক্স
স্কুলছাত্রীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত এক ১৩ বছরের কিশোর—এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নির্মিত ব্রিটিশ সিরিজ ‘অ্যাডোলেসেন্স’ মুক্তির পর রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারও সিরিজটির প্রশংসা করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষাক্ত প্রভাব কীভাবে তরুণ প্রজন্মকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে, তা এখানে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উঠে এসেছে। আবার এ খুনের ঘটনাটি কীভাবে তার পরিবার, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং বিচারব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দেয়, সিরিজটি সেই উত্তেজনার প্রতিটি মুহূর্তকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
এই সিরিজের প্রতিটি পর্ব চিত্রায়িত হয়েছে ওয়ান টেকে, যা কাহিনিকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তবে সিরিজটি দেখার পর কোনো সহজ সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন না আপনি; বরং এক কঠিন বাস্তবকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সিরিজটি।
জ্যাক থোর্ন ও স্টিফেন গ্রাহামের সিরিজে অভিনয় করেছেন স্টিফেন গ্রাহাম, ওয়েন কুপার, অ্যাশলি ওয়ালটারস। প্রধান চরিত্রে ওয়েন কুপারের অভিনয় ছিল বছরের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি, পরে সিরিজটির জন্য এমিও জিতেছেন তিনি।
১৩. ‘সেভারেন্স’, অ্যাপল টিভি
অ্যাপল টিভি প্লাস অনেক বড় বাজেটের কাজ করলেও ‘সেভারেন্স’ ছিল এক সত্যিকারের চমক। এটি একটি সাই-ফাই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। লুমিন ইন্ডাস্ট্রিজ নামে এক কোম্পানি তাদের কর্মীদের মস্তিষ্কে একটি চিপ বসিয়ে দেয়, যার ফলে কর্মক্ষেত্রে থাকাকালীন তাঁরা বাইরের জীবনের কথা ভুলে যায়। আবার বাড়িতে থাকলে ভুলে যায় অফিসের কথা!
এটি কর্মীদের কাজের জগৎ আর ব্যক্তিগত জীবনকে চিরতরে আলাদা করে দেওয়ার যে অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক ধারণা, যা দর্শককে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। আধুনিক করপোরেট সংস্কৃতি নিয়ে এটি এক অদ্ভুত নির্মাণ।
২০২৫ সালে মুক্তি পাওয়া সিকুয়েলগুলোর মধ্যে এটি নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। দ্বিতীয় মৌসুমটি মাঝপথে কিছুটা ধীর মনে হলেও এর নির্মাণশৈলী ও রহস্যময় দিক ছিল জোরালো। বিশেষ করে ব্রিটন লোয়ারের অভিনয় ছিল অনবদ্য। লুমোন করপোরেশনের অন্দরে আসলে কী ঘটছে, সেই উত্তর পেতে এখন তৃতীয় মৌসুমের অপেক্ষায় থাকতে হবে দর্শকদের।
১৪. ‘দ্য পিট’, এইচবিও
এটি একটি বাস্তবঘেষাঁ মেডিকেল ড্রামা, যেখানে পিটসবার্গের একটি ব্যস্ত হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে কাজ করা ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন দেখানো হয়েছে।
সিরিজটি সেবামূলক পেশার মানসিক চাপ ও মনস্তত্ত্বকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। নোয়া ওয়াইল এখানে ‘ডক্টর রবি’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। মহামারির সময় মেন্টরকে বাঁচাতে না পারার ট্রমা বয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি।
অন্যান্য মেডিকেল ড্রামার মতো এখানে ব্যক্তিগত আবেগকাহিনি মুখ্য নয়; বরং কাজ ও রোগীর জীবন-মৃত্যুর লড়াইকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রতি পর্বে ১৫ ঘণ্টার একেকটি শিফট রিয়েল টাইমে দেখানো হয়েছে, যা দর্শককে সরাসরি হাসপাতালের করিডরে নিয়ে যায়।
আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ, রোগীদের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক এবং ডাক্তারদের ব্যক্তিগত ত্যাগের গল্প নিয়ে সিরিজটি তৈরি। তবে ‘দ্য পিট’কোনো গতানুগতিক মেলোড্রামাটিক মেডিকেল শো নয়; বরং সিরিজটি বর্তমান বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতের সত্যিকারের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছে।
১৫. ‘প্যারাডাইস’, হুলু
‘প্যারাডাইস’একটি হাইপ্রোফাইল রাজনৈতিক মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার। গতানুগতিক পলিটিক্যাল থ্রিলার হিসেবে এর গল্প শুরু হলেও খুব দ্রুতই গল্পের মোড় পাল্টায়। একটি অত্যন্ত নিরাপদ ও বিলাসবহুল আবাসনের ভেতরে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এর গল্পের সূচনা।
সেখানে বসবাসকারী এক ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসে রাজনীতি ও দুর্নীতির গভীর শিকড়।
এই সিরিজে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তাপ্রধানের চরিত্রে স্টার্লিংকে ব্রাউন দুর্দান্ত। নিজের বসের খুনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়া এবং তার পেছনে থাকা গভীর রহস্য—সব মিলিয়ে টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এক সিরিজ এটি।
নির্মাতা ‘দিস ইজ আস’খ্যাত ড্যান ফোগেলম্যান গল্পের বুননে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সিরিজের একটি বিশেষ পর্বের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, যা দেখে দর্শকেরা স্রেফ থমকে যাবেন। পরতে পরতে ধোঁয়াশা ও রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ পছন্দ করলে এটি আপনার জন্য চলতি বছরের সেরা সিরিজ হতে পারে।