Thank you for trying Sticky AMP!!

'আমি বাঁচতে চাই, গাইতে চাই'

কয়েক দিন আগেও গান গেয়ে মঞ্চ মাতাতেন আকবর। কণ্ঠে তুলে নিতেন কিশোর কুমার, কুমার শানু, সৈয়দ আবদুল হাদীর জনপ্রিয় সব গান। গাইতেন নিজের গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় কিছু গানও। এসব গানে শ্রোতারা মাতোয়ারা হতেন, শিল্পীর সঙ্গে মেলাতেন কণ্ঠ। কণ্ঠের জাদুতে দর্শকেরা ভাসতেন সীমাহীন আনন্দে। দর্শকের তুমুল করতালিতে আকবর হতেন অনুপ্রাণিত। দর্শকের প্রিয় সেই গায়কের দিন কাটছে হাসপাতালের বিছানায়। ডায়াবেটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পুরো শরীরে ফোসকা পড়ে গেছে তাঁর।

শনিবার সকালে হাসাপাতালের বিছানায় কাতরাতে দেখা যায় গায়ক আকবরকে। বিছানায় পিঠ লাগতে পারেন না। কাত হয়ে ঘুমাতে হয়। ফোসকার যন্ত্রণায় কিছুক্ষণ পর পর ভেঙে যায় ঘুম। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদেন তিনি। দেখা করতে গেলে এই প্রতিবেদকের সামনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি।

সাত বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন আকবর। দুই বছর হলো তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে জন্ডিস, রক্তে প্রদাহসহ নানা রোগ। তাই আগের মতো এখন আর মঞ্চে গাইতে পারেন না। বেশ কিছুদিন বিরতির পর সর্বশেষ গান গেয়েছেন ১১ জানুয়ারি, সাভারে। মেয়ের স্কুলের ভর্তির টাকা জোগাড় করতে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। বাসায় ফিরে সেই যে শয্যাসায়ী হয়েছেন, আর উঠতে পারেননি। কেবল বিছানা বদলে তাঁকে নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে। রাজধানীর পিজি হাসপাতালে গত মঙ্গলবার ভর্তি হন গায়ক আকবর। শুরুতে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে, পরে ডি ব্লকের মেডিসিন বিভাগের ১৬ এ ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রহিমের তত্ত্বাবধানে আছেন তিনি, জানালেন আকবরের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা।

কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’ নতুন করে গেয়েছিলেন আকবর আলী গাজী। সবার কাছে তিনি আকবর নামে পরিচিত। হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত এই গান তাঁকে আলোচনায় নিয়ে আসে। এরপর ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ গানটি দেশে ও দেশের বাইরের দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। আলোচিত গায়কের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্যও নেই। তাই হাসপাতালের বিনা মূল্যের বিছানায় কাটছে তাঁর সময়। আকবরের পাশে সেদিন বসে ছিলেন তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘তাঁর চিকিৎসা করাতে আমরা সর্বস্বান্ত। জমি বিক্রির টাকা ও জমানো টাকা মিলে ছিল লাখ দশেক টাকা ছিল। যশোরে পাঁচ কাঠার একটি জমি ছিল। ওকে বাঁচাতে দুই কাঠা বিক্রি করতে বাধ্য হই। জমির চেয়ে আমার স্বামীর জীবন তো আগে।’

পিজি হাসপাতালের বিছানায় গায়ক আকবর। ছবি: প্রথম আলো

পাঁচ দিন ধরে হাসপাতালের বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছেন আকবর। শুরুতে টাকার বিনিময়ে বিছানা পেলেও, এখন ফ্রি বেডে চলছে চিকিৎসা। আকবরের চিকিৎসার জন্য ২৫ লাখ টাকা দরকার বলে জানিয়েছেন স্ত্রী। আকবর বলেন, ‘আমার কারণে পুরো পরিবার পথে বসতে যাচ্ছে। এত রোগ আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছেন যে, এর পেছনেই আমার টাকাপয়সা সব শেষ। পত্রিকায় আমার অসুস্থতার খবর প্রকাশের পর অনেকে সহযোগিতা করছেন। আমি সবাইকে হাতজোড় করে বলছি, প্লিজ আমার পাশে দাঁড়ান। আমাকে সহযোগিতা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংস্কৃতি জগতের অনেককে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর এই সহযোগিতায় সবাই সুচিকিৎসা পেয়েছেন। সুস্থভাবে জীবনযাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই—আমি বাঁচতে চাই, গাইতে চাই। আপনি আমাকে বাঁচান, আমাকে আবার গাইবার সুযোগ করে দিন।’

আকবরের চিকিৎসার দেখভাল করছেন হানিফ সংকেত। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, পরিচিতজনদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে অকবরের চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। ভারতের ভেলোরে ২০১৫ সালে টানা এক মাসের কিডনির চিকিৎসাখরচ হানিফ সংকেত দিয়েছিলেন বলে জানান আকবরের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। এবার হাসপাতালে ভর্তি করিয়েও দিয়েছেন তিনি। কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘স্যার (হানিফ সংকেত) যখন যেভাবে পেরেছেন, সাহায্য করছেন। ডাক্তারকে বলে বেড ফ্রি করে দিয়েছেন। তবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও ওষুধ বাবদ হাজার হাজার টাকা প্রতিদিন খরচ হচ্ছে। তাঁকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে এখন অনেক টাকার প্রয়োজন।’

আকবর বলেন, ‘আমি অজপাড়াগাঁয়ে গান করতাম। রিকশা চালাতাম। সেখান থেকে আমাকে তুলে এনেছেন হানিফ সংকেত স্যার। এরপর গান গেয়েই আয় করেছি। দেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা জয় করেছি। যত দিন বেঁচে থাকব, গানই গাইব।’

হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় কেঁদে ওঠেন আকবর। কষ্ট করে হাত ধরে বললেন, ‘ভাই–আমারে বাঁচান। আমারে নিয়ে একটু লেখেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অসুস্থতার খবরটা পৌঁছে দিন, প্লিজ। তাহলে আমি হয়তো বাঁচতে পারব। আবার গাইতে পারব। সুস্থ হয়ে নিজের আয়ে চলতে পারব।’

পরিবার নিয়ে আকবর মিরপুর ১৩ নম্বরে থাকেন। তাঁর বড় মেয়ে আছিয়া আকবর অথৈ হারম্যান মাইনর স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে কামরুল ইসলাম ও মহরম থাকে গ্রামের বাড়ি যশোরে।

গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে যশোরে রিকশা চালাতেন আকবর। খুলনার পাইকগাছায় জন্ম হলেও আকবরের বেড়ে ওঠা যশোরে। গান শেখা হয়নি। তবে আকবরের ভরাট কণ্ঠের কদর ছিল যশোর শহরে। সে কারণে স্টেজ শো হলে ডাক পেতেন তিনি। ২০০৩ সালে যশোর এম এম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন আকবর। বাগেরহাটের এক ব্যক্তি আকবরের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে চিঠি লেখেন আকবরকে নিয়ে। এরপর ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ আকবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই বছর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’ গানটি গেয়ে রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে যান আকবর।