১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল ব্লু বার্ডের যাত্রা। ৩৮ বছর পরও সুরের সাধনায় নিরন্তর তারা
১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল ব্লু বার্ডের যাত্রা। ৩৮ বছর পরও সুরের সাধনায় নিরন্তর তারা

ব্লু বার্ড: ৩৮ বছর পরও উড়ছে নীল পাখিরা

১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে ‘ব্লু বার্ড’। তিন যুগ পরও সুরের ডানায় ভর করে উড়ে চলেছে বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড। ব্লু বার্ডের পথচলার আরও গল্প শোনাচ্ছেন ওমর কায়সার

১৯৯০ সালের ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম বিজয় মেলার মঞ্চের সামনে হাজারো দর্শক। মঞ্চে গিটার, ড্রামস, কি–বোর্ড আর নানা বাদ্যযন্ত্র হাতে একদল তরুণী। তাঁরা গেয়ে ওঠেন ‘এই দিন চিরদিন সূর্যের মতো জ্বলবে’। তাঁদের বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে দর্শকদের মনে জাগে উচ্ছ্বাসের ঢেউ, হাততালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। মঞ্চে শুধু মেয়েদের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ একটা কনসার্ট! চট্টগ্রামের দর্শকদের জন্য এটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু চট্টগ্রামই বা বলি কেন, গোটা বাংলাদেশই প্রথমবার পেল মেয়েদের নিজস্ব এক ব্যান্ড—‘ব্লু বার্ড’।
তবে আরও আগে, ১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল ব্লু বার্ডের যাত্রা। সে সময় ‘স্পাইডার’ ছিল চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড। এই ব্যান্ডের পুরোধা ছিলেন জ্যাকব ডায়েস। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়ার পাশাপাশি একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলে। সেই কেন্দ্রকে ঘিরে জ্যাকব ডায়েসের হাত ধরে উঠে এসেছেন অনেক গুণী শিল্পী। আইয়ুব বাচ্চুও গিটার শিখেছেন জ্যাকবের কাছে। সেই সময়ে একদিন তাঁর মনে হলো, কত ছাত্রী গিটার শেখে, গান শেখে; কিন্তু শেখার পর তাদের আর দেখা মেলে না। তাদের দিয়ে একটা গানের দল করলে কেমন হয়? মনের এই ভাবনাটুকু তিনি শেয়ার করলেন তাঁরই এক ছাত্রী ও কন্যা রুদমিলা ডায়েসের সঙ্গে। বাবার এমন প্রস্তাবে রুদমিলার মনেও স্বপ্নেরা ডানা মেলে। বাবার মতো সেও একদিন মঞ্চে গান গাইবে। শত শত মানুষ করতালি দেবে। রুদমিলার বয়স তখন ১৩। আরেক ছাত্রী আনজুমান আরাকেও নিজের স্বপ্নের কথা বললেন জ্যাকব। সেও খুব উৎসাহী। তাদের সাড়ায় জ্যাকব প্রেরণা পেলেন। বললেন আরও কয়েকজনকে। সবার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ।

একদিন সবাইকে ডেকে জ্যাকব ঘোষণা দিলেন—দলের নাম হবে ব্লু বার্ড। আমাদের দেশের প্রথম নারী ব্যান্ডটির এভাবেই যাত্রা শুরু হলো। আর সেই ঐতিহাসিক গল্পের চরিত্রগুলো হলো লিড গিটারিস্ট রুদমিলা ডায়েস, বেজ গিটারিস্ট টিনা ডিকস্টা, প্রয়াত ভোকাল ক্যাথরিন ডায়েস, ভোকাল এ্যানিটা বিভেরো, ভোকাল মুক্তা, কি–বোর্ডবাদক আনজুমান আরা, জুমলি চৌধুরী, ড্রামবাদক ঈষিকা সেন, বেজ গিটারিস্ট বিভা গোমস ও ফারজানা।
১৯৯২ সালে একটি কানসার্টে গান করছে ব্লু বার্ড

নাম হবে ব্লু বার্ড
একদিন সবাইকে ডেকে জ্যাকব ঘোষণা দিলেন—দলের নাম হবে ব্লু বার্ড। আমাদের দেশের প্রথম নারী ব্যান্ডটির এভাবেই যাত্রা শুরু হলো। আর সেই ঐতিহাসিক গল্পের চরিত্রগুলো হলো লিড গিটারিস্ট রুদমিলা ডায়েস, বেজ গিটারিস্ট টিনা ডিকস্টা, প্রয়াত ভোকাল ক্যাথরিন ডায়েস, ভোকাল এ্যানিটা বিভেরো, ভোকাল মুক্তা, কি–বোর্ডবাদক আনজুমান আরা, জুমলি চৌধুরী, ড্রামবাদক ঈষিকা সেন, বেজ গিটারিস্ট বিভা গোমস ও ফারজানা। এদের প্রত্যেককে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করলেন জ্যাকব। গান লেখালেন। সুর দিলেন। তারপর এই নবীন গানের পাখিদের কণ্ঠে তুললেন—‘সৈকতে একদিন নির্জন সন্ধ্যায়’। প্রথম গানেই ওরা পরিচিত মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আর ১৯৯০ সালে বিজয় মেলায় গানের মাধ্যমে বৃহত্তর সমাজে তাঁদের পরিচিতি গড়ে ওঠে। এর পরপরই বিটিভিতে ঈদ ব্যান্ড শোতে পারফরম্যান্স। ১৯৯২ সালে সৈকতে একদিন শিরোনামে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ। ১৪টি গান ছিল। সেই পথচলা এখনো থামেনি। বর্তমানে ব্লু বার্ডের লিড গিটারে আছেন আয়রা তানজিন ও রুদমিলা ডায়েস। রিডম গিটার ও ভোকালে লোরেন। বেজ গিটারে টিনা ডিকস্টা । কি-বোর্ডে শিলা রায় ও রোকেয়া লিপি। কি-বোর্ড ও ভোকালে ঈদি ও আনজুমান আরা। ভোকাল আরও রয়েছেন কুইন গোমেজ, অর্পা, রেখা দে, আফরোজ বেলী, রওশন আরা, রুশনি ও রুবা। ড্রামসে আছেন আফরোজ বেলী, অন্তি ও নিশা। প্রথম দিকের সদস্যদের মধ্যে দুজন প্রয়াত। অন্য সবাই চট্টগ্রামে বিভিন্ন পেশায় আছেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। নিজেরা পারফরম্যান্স করেন, পাশাপাশি দলের নবীন সদস্যদের প্রেরণা দেন। নবীন সদস্য চট্টগ্রাম কলেজের সম্মানের ছাত্রী আয়রা তানজিন বলেন, ‘মাঝখানে কিছুটা বিরতি ছিল। এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছি। সামনে ডিসেম্বরে দুটো নতুন গান রিলিজ হবে। রোজার ঈদের আরও একটি নতুন গান প্রকাশ পাবে। ২০২৬–এ আমাদের নতুন অ্যালবামও প্রকাশিত হবে।’

১৯৯০ সালে বিজয় মেলায় গানের মাধ্যমে বৃহত্তর সমাজে তাঁদের পরিচিতি গড়ে ওঠে। এর পরপরই বিটিভিতে ঈদ ব্যান্ড শোতে পারফরম্যান্স। ১৯৯৩ সালে সৈকতে একদিন শিরোনামে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ। ১৪টি গান ছিল। সেই পথচলা এখনো থামেনি।
সৈকতে একদিন শিরোনামে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ

প্রজন্মের পর প্রজন্ম
কয়েক দিন আগে সকালবেলা ব্লু বার্ডের ইতিহাস জানতে গিয়েছিলাম জ্যাকব ডায়েসের চট্টগ্রামের লালখান বাজারের বাসায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শুরুর দিকের এবং এখনকার কয়েকজন ব্লু বার্ড। জ্যাকবের হাতে অ্যালবাম সাইজের বিরাট একটা খাতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সংগীতজগতে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকার সব খবর, প্রতিবেদন, ফিচার ও ছবি সেই খাতায় পেস্ট করে রেখেছেন। এখন এই পরিণত বয়সে স্মৃতির খাতাটি খুলে অতীতের কর্মমুখর দিনগুলোতে ফিরে যান জ্যাকব।

মাঝখানে কিছুটা বিরতি ছিল। এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছি। সামনে ডিসেম্বরে দুটো নতুন গান রিলিজ হবে। রোজার ঈদের আরও একটি নতুন গান প্রকাশ পাবে। ২০২৬–এ আমাদের নতুন অ্যালবামও প্রকাশিত হবে।
আয়রা তানজিন
বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড ব্লু বার্ডের নবীন ও প্রবীণ সদস্যরা। গতকাল চট্টগ্রাম নগরের বাটালীহিলে

শুরুর দিকে ব্লু বার্ড আর এখনকার ব্লু বার্ডের মধ্যে পার্থক্য কী? জানতে চাইলাম জ্যাকবের কাছে। তিনি বললেন, ‘তখনকার সামাজিক পরিস্থিতি আর বর্তমানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু মেয়েদের নিয়ে কিছু করার চ্যালেঞ্জটা একই রকম রয়ে গেল। তবে আগে সরাসরি দর্শক–শ্রোতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এখন সেটা করতে হয় না, মিডিয়ার মাধ্যমে শ্রোতার সঙ্গে যোগাযোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন নতুন গান ছড়িয়ে দিচ্ছেন এই সময়ের শ্রোতাদের কাছে। যন্ত্রের সুবিধা বেড়েছে। নতুন সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন এখন তাঁরা। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তর। অন্তর ঠিক তো যন্তর ঠিক। শিল্পী হতে হলে অন্তরে দরদ থাকতে হবে। আমি সেই অন্তর ঠিক করার প্রশিক্ষণ দিই।’

জ্যাকব ডায়েস

বর্তমানে ব্লু বার্ডের অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করেন স্পাইডারের লরেন্স ডায়েস। তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা ভেতর থেকে প্রেরণা দিই। সব কাজ ওরাই করে।’

অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু মেয়েদের নিয়ে কিছু করার চ্যালেঞ্জটা একই রকম রয়ে গেল। তবে আগে সরাসরি দর্শক–শ্রোতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এখন সেটা করতে হয় না, মিডিয়ার মাধ্যমে শ্রোতার সঙ্গে যোগাযোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন নতুন গান ছড়িয়ে দিচ্ছেন এই সময়ের শ্রোতাদের কাছে। যন্ত্রের সুবিধা বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তর। অন্তর ঠিক তো যন্তর ঠিক। শিল্পী হতে হলে অন্তরে দরদ থাকতে হবে।
জ্যাকব ডায়েস
৩৮ বছর পরও সুরের সাধনায় নিরন্তর ব্লু বার্ড

কাজটা সহজ ছিল না
শুরুর সেই দিনটি কেমন ছিল, জানতে চেয়েছিলাম রুদমিলা ডায়েসের কাছে। তিনি বলেন, ‘সেদিনের কথা ভুলব না। আমার শুধু মনে পড়ে বিজয় মেলার সেই দিনটির কথা। সবাই বাহবা দিয়েছিল। অনেক মানুষের সামনে গান করেছি, কিন্তু তেমন ভয় ছিল না। খুব খুশি ছিলাম আমরা, অনেকের প্রশংসা পেয়েছি তো।’

বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড ব্লু বার্ডের নবীন ও প্রবীণ সদস্যরা। গতকাল চট্টগ্রাম নগরের বাটালীহিলে। ছবি: সৌরভ দাশ

কীভাবে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ব্যান্ড দুনিয়ায় নিজেদের জায়গা করে নিলেন তাঁরা, কীভাবে সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেছেন? রুদমিলা বলেন, ‘সামাজিক বাধাবিপত্তির কথা মনে আসেনি। বয়স তো কম ছিল। প্রাণপণ চেষ্টা করেছি, অন্তর দিয়ে কাজ করেছি। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম—কাজটা খুব সহজ ছিল না। আমাদের সতীর্থরা পারিবারিক, সামাজিক অনেক বাধা পেরিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে যোগ দিত। মেয়েরা পড়ালেখা করবে, তারপর বয়স হলে বিয়ে হয়ে যাবে। তাদের কী দরকার এত সব অনুষ্ঠান–টনুষ্ঠান করার—এটাই ছিল পরিবারগুলোর মানসিক অবস্থান।’

প্রয়াত সদস্য সীমা ও পপি

মঞ্চে উঠে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উচ্চ স্বরে গান করার দৃশ্য দেখে তাঁদের ভালো লাগলেও কোথাও একটা ভয়ের ব্যাপার ছিল।
৩৮ বছর পরও সুরের সাধনায় নিরন্তর ব্লু বার্ড। তারা প্রমাণ করেছে, আন্তরিক প্রচেষ্টা আর ভালোবাসা থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়। পুরোনো প্রজন্মের অনুপ্রেরণা আর নতুন প্রজন্মের আবেগে আজও সুরের আকাশে নীল পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।