‘লিচুর বাগানে’ গান নিয়ে উন্মাদনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন ছত্তার পাগলা
‘লিচুর বাগানে’ গান নিয়ে উন্মাদনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন ছত্তার পাগলা

‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, কে এই ছত্তার পাগলা

‘লিচুর বাগানে’ গান নিয়ে উন্মাদনার মধ্য দিয়ে সামনে আসছে নেত্রকোনার সংগীতশিল্পী ছত্তার তালুকদারের নাম , যিনি নিজেকে ‘ছত্তার পাগলা’ বলে পরিচয় দিতেন।

পবিত্র ঈদুল আজহায় মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘তাণ্ডব’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। গানটি প্রকাশের পরই রীতিমতো আলোচনার ঝড় তুলেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে, কে এই ছত্তার পাগলা? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের একজন তিনি। ট্রেনে, স্টেশনে, বাজারের মজমায় ঘুরে ঘুরে গান করতেন ছত্তার পাগলা।

২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। মৃত্যুর ১১ বছর পর ‘লিচুর বাগানে’ গানের সুবাদে তিনি আলোচনায় এলেন। ভাটি অঞ্চল ছাপিয়ে দেশজুড়ে পরিচিতি পেলেন এই সংগীতশিল্পী। ৮৭ বছরের জীবদ্দশায় কয়েক শ গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন তিনি।

২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। মৃত্যুর ১১ বছর পর ‘লিচুর বাগানে’ গানের সুবাদে তিনি আলোচনায় এলেন।

‘লিচুর বাগানে’ গানটি কার

দীর্ঘদিন ধরে ছত্তার পাগলার গান নিয়ে গবেষণা করছেন কবি সরোজ মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিচুর বাগানে’ গানটির গীতিকার ও সুরকার ছত্তার পাগলা। তিনি জীবদ্দশায় পাণ্ডুলিপিতেও গানটি রেখে গেছেন।

সরোজ মোস্তফা জানান, গানটা আশির দশকের আগে কেউ কোথাও শোনেননি। গানটা প্রথম জনসমাজে নিয়ে এসেছেন ছত্তার পাগলা।

সরোজ মোস্তফা আরও জানান, গানটি পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাটির গান। এটি একটি ঘেটু (গাডু) গান। কৈশোরে ছত্তার পাগলা ঘেটু গানের দলে ছিলেন, ঘেটু গানের সংস্কৃতি থেকেই গানটির জন্ম।

তবে আরেক সংগীতগবেষক গৌতম কে শুভ দাবি করেছেন, এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গান। ‘কে দিল পিরিতির বেড়া লিচুর বাগানে?’ অংশটি মূল গানের অংশ। এর সঙ্গে ছত্তার পাগলা নিজের মতো করে কথা সংযোজন করেছেন। নেত্রকোনায় ছত্তার পাগলার লেখা রূপটিই বিখ্যাত হয়েছে।

ছত্তার পাগলার মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে গানটি হাতে লিখে রেখেছিলেন আল মামুন চৌধুরী

গৌতম কে শুভ বলেন, লোকগান বরাবরই মানুষের মুখে মুখে ছড়ায়, পরে এতে লোকশিল্পীরা নিজের মতো করে কথা যোগ করে থাকেন।

কবি সরোজ মোস্তফার দাবি, ‘লিচুর বাগানে’ গানটি ছত্তার পাগলারই লেখা। ছত্তার পাগলার মধ্য দিয়েই গানটি প্রচলিত হয়েছে। তিনি বলেন, ছত্তার পাগলা যে ধরনের গানের শব্দচয়ন করেন, সেটার সঙ্গে গানটার মিল রয়েছে।

ছত্তার পাগলা মুখে মুখে গান বাঁধতেন। খুব একটা লিখতে–পড়তে পারতেন না। তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে অন্যরা গান লিখে রাখতেন। তাঁর বেশির ভাগ গান লিখে রেখেছেন আল মামুন চৌধুরী নামের এক চিকিৎসক। মোহনগঞ্জের আল মামুনের চেম্বারে নিয়মিত আড্ডা দিতেন ছত্তার পাগলা।

আল মামুন চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, গানটি ছত্তার পাগলার রচিত। দশকের পর দশক ধরে তাঁর কণ্ঠে ‘লিচুর বাগানে’ শুনেছেন ভাটি অঞ্চলের শ্রোতারা। ছত্তার পাগলার মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে গানটি হাতে লিখে রেখেছিলেন তিনি। সেটি ছত্তার পাগলার ভার্সন।

ছত্তার পাগলার কাছে গানটির মর্মার্থ জানতে চেয়েছিলেন আল মামুন চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, যত্নের লিচুর বাগান দুষ্টু ছাগলে খেতে আসে। ফলে বাগানে বেড়া দিয়েছেন। ঘেটু গানটিতে প্রতীকীভাবে প্রেমকে তুলে ধরেছেন তিনি।

মৃত্যুর আগে নেত্রকোনার কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক রইস মনরমের কাছে গানগুলো রেখে গেছেন ছত্তার পাগলা। রইস মনরমের কাছে আল মামুন চৌধুরীর হাতে লেখা ‘লিচুর বাগানে’ গানটিও রয়েছে। গানটির একটি অনুলিপি প্রথম আলোর কাছে এসেছে।

রইস মনরম প্রথম আলোকে বলেন, ছত্তার পাগলার গানটি ভাটি অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়।

ছত্তার পাগলার গানটি ভাটি অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়।
রইস মনরম, সাংস্কৃতিক সংগঠক
ছত্তার পাগলা
ছত্তার পাগলার জন্ম নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার লালচাপুর গ্রামে, সেখানেই বেড়ে ওঠা। একাত্তরের পর পুরো পরিবার নিয়ে পাশের উপজেলা বারহাট্টার নুরুল্লাচর গ্রামে বসতি গড়েন।

কে এই ছত্তার পাগলা

ছত্তার পাগলার জন্ম নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার লালচাপুর গ্রামে, সেখানেই বেড়ে ওঠা। একাত্তরের পর পুরো পরিবার নিয়ে পাশের উপজেলা বারহাট্টার নুরুল্লাচর গ্রামে বসতি গড়েন। আমৃত্যু সেখানেই বাস করেছেন তিনি।

রইস মনরম বলেন, গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে নেত্রকোনার প্রতিটি গ্রামে লেটো গানের দল ছিল, শৈশবে রাতে ঘর থেকে পালিয়ে গান শুনতে শুনতে গানের প্রতি আসক্তি জন্মে ছত্তারের। একসময় নিজেও একটি লেটো গানের দলে ভিড়েছিলেন তিনি। পরে গানের দল ছেড়ে নিজেই গান লেখা শুরু করেন, সুর তুলে নিজেই সেই গান পরিবেশন করেন। সত্তর-আশির দশকে রেলস্টেশন কিংবা হাটবাজারে গানের মজমা জমিয়ে তুলতেন তিনি। ট্রেনে ও রেলস্টেশনেও গান করতেন।

‘তওবা কইরা বল খেলাডা ছাড়’, ‘কাঙ্গাল মাইরা জাঙ্গাল দিলে গোনাহ হইবো তোর’, ‘ইঞ্জিন ছাড়া ঠেলাইয়া নেই খালি মালগাড়ি’সহ ছত্তার পাগলার বেশ কয়েকটি গান ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

‘লিচুর বাগানে’সহ এসব গান নিয়ে শিগগিরই একটি বই প্রকাশিত হবে।

‘লিচুর বাগানে’ গানের দৃশ্য। ছবি : প্রযোজনা সংস্থার ফেসবুক

নতুনভাবে ‘লিচুর বাগানে’

‘তাণ্ডব’ সিনেমার জন্য নতুন করে ‘লিচুর বাগানে’ লেখা হয়েছে। এতে ছত্তার পাগলার ‘লিচুর বাগানে’ গানের অংশবিশেষ নেওয়া হয়েছে। গানটি নতুন করে লিখেছেন প্রীতম হাসান, মেহেদী আনসারি ও ইনামুল তাহসিন। এতে কণ্ঠ দেন প্রীতম ও জেফার, সঙ্গে আছেন আলেয়া বেগম ও মঙ্গল মিয়া। গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন প্রীতম হাসান।

সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফী প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা পুরোনো দিনের একটি গানকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। সেই ভাবনা থেকে গানটি নেওয়া হয়েছে।