বড় ছেলে আজরাফ আহমেদ অজির সঙ্গে শাফিন আহমেদ
বড় ছেলে আজরাফ আহমেদ অজির সঙ্গে শাফিন আহমেদ

জুলাইয়ে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে মৃত্যুর আগে সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি শাফিন

জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। কনসার্টে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন শাফিন, ভার্জিনিয়ার শোর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এ কারণে শো বাতিল করে সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় তাঁকে। এরপর আর ফেরানো যায়নি। মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটি পারিবারিকভাবে পালন করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় মিলাদের সঙ্গে কবর জিয়ারত করতে যাবে পুরো পরিবার।

শাফিন আহমেদের বড় ছেলে আজরাফ আহমেদ অজি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর সব আয়োজন নিজেদের মধ্যে করছি। সন্ধ্যায় মিলাদ ও কবর জিয়ারতে যাব। সব সময় তো তাঁকে মিস করি, তবে আজ যেন সারা দিন ধরেই বাবার স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।’
সবার কাছে ব্যান্ড তারকা হলেও অজির কাছে শাফিন আহমেদ ছিলেন একজন ফ্যামিলিম্যান। যেকোনো ছোট আয়োজন হলেও পরিবারের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। অজি বলেন, ‘আমরা বাচ্চারা কত আইডিয়া তাঁর সঙ্গে শেয়ার করতাম, কিন্তু কখনো তিনি বিরক্ত হতেন না। অলওয়েজ পজিটিভ রেসপন্স করতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন।’

শাফিন আহমেদের সঙ্গে এক মঞ্চে অজি

গত এক বছরে প্রতিটি দিনই বাবার অভাবটা আরও বেশি করে টের পেয়েছেন অজি। কনসার্টের ব্যস্ততায় যেখানেই শাফিন থেকেছেন, সন্তানদের প্রতিমুহূর্তের খবর নিতেন তিনি। অজির কথায়, ‘হয়তো তিনি ব্যস্ততায় শারীরিকভাবে সময় কম দিতে পারতেন, তবে সব সময় ফোনকল, মেসেজে যুক্ত থাকতেন। কখনো আমরা দেরিতে উত্তর দিলে কষ্ট পেতেন। উনি শুধু বাবা নন, একজন বন্ধু ছিলেন আমাদের। ওনার অভাবটা টের পাই প্রতিটি মুহূর্তে।’
শাফিন আহমেদের বড় সন্তান অজি নিজেও গান করেন। র‌্যাপ গানের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। বাবার সঙ্গে মঞ্চে একসঙ্গে ‘জাদু’ গানটি গেয়েছেন তিনি। এই স্মৃতিকে জীবনের সেরা অর্জন মনে করেন তিনি। অজির কথায়, ‘একজন কিংবদন্তি শাফিন আহমেদের সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার আমার জীবনের অনেক বড় অর্জন। ওনার সঙ্গে কয়েকটা শোতে অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু শো শেষ হওয়ার আগে উনি এক সেকেন্ডের জন্য বুঝতে দেননি আমি তাঁর সন্তান। শো শেষে ঠিকই পাশে এসে পানি এগিয়ে দিয়ে হয়তো বলেছেন, ভালো করেছ। কিন্তু পারফরম্যান্সের সময় উনি এতই সিরিয়াস থাকতেন, ভয়ে ভয়েই থাকতাম।’

যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্ট করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় শাফিন আহমেদের। কনসার্টের ব্যস্ততায় অজির সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছে কিছুটা কম। এরই মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে উত্তাল সারা দেশ। ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন অজি। শেষ কথায় অজিকে শুভকামনা জানিয়ে, নিজের যত্ন নেওয়ার কথা বলেন শাফিন। এরই মধ্যে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। শেষ সময়ে বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি অজি। অজি বলেন, ‘তখন সবার সঙ্গে আমিও আন্দোলনে। র‍্যাপার সেজানের “কথা ক” গানটি বাবাকে পাঠিয়ে বলি, “দেখো বাবা, কত শক্তিশালী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।” এরপর তিনি আমাকে নিজের যত্ন নিতে বলেন। এরপর ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। এ যন্ত্রণা অনেক দিন ভোগাবে।’
দেশের ব্যান্ড সংগীতে শাফিন আহমেদ যেমন বড় তারকা, সন্তানদের কাছে তিনি ছিলেন নির্ভরতা আর সাহসের জোগানদাতা। বাবাকে ভীষণ মিস করলেও তাঁর অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশের সংগীতে অবদান রাখতে চান অজি।
বাংলা সংগীতের দুই মহারথি সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের ছেলে শাফিন নিজে ছিলেন বেজ গিটারিস্ট, সুরকার ও গায়ক। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত আর মায়ের কাছে নজরুলগীতি শিখেছেন। ফরিদ রশিদের হাত ধরে ১৯৭৯ সালে বড় ভাই হামিন আহমেদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন ব্যান্ড ‘মাইলস’। প্রথম কয়েক বছর তাঁরা বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলে ইংরেজি গান গাইতেন।
এরই মধ্যে প্রকাশিত হয় দুটি ইংরেজি গানের অ্যালবাম ‘মাইলস’ ও ‘আ স্টেপ ফারদার’। পরে মাইলসের বাংলা গানের প্রথম অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’ বের হয় ১৯৯১ সালে। ওই অ্যালবামের জনপ্রিয়তার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে মাইলসকে। ধীরে ধীরে মাইলস দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ডে পরিণত হয়।

শাফিন আহমেদ

২০২১ সালে মাইলস থেকে আলাদা হয়ে শাফিন আহমেদ গড়ে তোলেন ‘ভয়েস অব মাইলস’ নামে তাঁর নিজস্ব একটি ব্যান্ড। এর আগে ২০১৭ সালের অক্টোবরেও তিনি একবার ব্যান্ডটি ছাড়ার কয়েক মাস পর দ্বন্দ্ব ভুলে আবার ব্যান্ডে ফিরেছিলেন। ২০১০ সালের শুরুর দিকেও একবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর কয়েক মাস পর ব্যান্ডে ফেরেন।
মাইলসের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘প্রথম প্রেমের মতো’, ‘গুঞ্জন শুনি’, ‘সে কোন দরদিয়া’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘নীলা’, ‘কী জাদু’, ‘কতকাল খুঁজব তোমায়’, ‘পিয়াসী মন’, ‘বলব না তোমাকে’, ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ ও ‘প্রিয়তমা মেঘ’ উল্লেখযোগ্য।