
ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘তাণ্ডব’ ও ‘ইনসাফ’ সিনেমার কয়েকটি গানের সংগীতায়োজন করেছেন নাভেদ পারভেজ। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই তরুণ সংগীত পরিচালকের পথচলার গল্প শুনেছেন নাজমুল হক
২০০৫ সালে পরিবারের সঙ্গে যখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান, নাভেদ পারভেজের বয়স তখন মোটে ১৩ বছর। দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যেমনটা শুনে গিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে দেখেন উল্টো। টিকে থাকতে তাঁর পরিবারকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে হিপহপ, র্যাপ ইত্যাদি ধারার পশ্চিমা সংগীত শুনতেন। তবে তাঁর মন পড়ে ছিল বাংলাদেশের গানে। হাবিব ওয়াহিদের কৃষ্ণ, মায়া এবং ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের রি/ইভল্যুশন, ভেরিয়েশন নং. ২৫ অ্যালবামে নিজের ভালো লাগা খুঁজে পান নাভেদ। অ্যালবামের গানগুলো তাঁকে সংগীত পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। বড় ভাইয়ের কাছে কি-বোর্ডের বায়না ধরেন। ছোট ভাইয়ের মধ্যে সংগীতের তুমুল আগ্রহ দেখে বড় ভাই কিনেও দেন।
ইন্টারনেট ঘেঁটে ট্র্যাক বানাতে থাকেন নাভেদ। নিজের কাজ যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত পরিচালক ও স্টুডিওগুলোয় পাঠাতে থাকেন। কিন্তু কেউ তাঁকে ডাকে না। হতাশা গ্রাস করে। গান ছেড়ে দেবেন কি না, ভাবতে থাকেন। পরে মনে হয়, আরেকটু চেষ্টা করি। ফেসবুকে বাংলাদেশের সংগীত তারকাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। নিজের বিভিন্ন সংগীত ও গানের ট্র্যাক তাঁদের পাঠাতে থাকেন। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া নির্মাতা আশিকুর রহমানকেও নিজের কিছু কাজ পাঠান নাভেদ। কাজগুলো পছন্দ হওয়ায় কিস্তিমাত ছবিতে তাঁকে দুটি গান করার প্রস্তাব দেন আশিক। পারিশ্রমিক ঠিক করতে প্রযোজক যখন ফোন দেন, ঠিক কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না নাভেদ। কারণ, তিনি একটা সুযোগ খুঁজছিলেন, তবে তা যে এত বড় আকারে হবে, কল্পনা করতে পারেননি। সিনেমায় দুটি গানের সংগীত পরিচালনা করেন তিনি, এর মধ্যে ‘শুধু একবার বল’ গানটি জনপ্রিয়তা পায়। এ গানের কল্যাণে ইন্ডাস্ট্রির অনেকের সঙ্গেই নাভেদের পরিচয় হয়। সবাই তাঁর প্রশংসা করতে থাকেন। তবে কাজের জন্য কেউ ডাকেন না। এরই মধ্যে ‘শুধু একবার বল’ গানটি তিনি পাঠান ভারতের জনপ্রিয় সুরকার আমাল মালিকের কাছে। গানটি আমালের মনে ধরে। নাভেদকে তিনি বলেন, ‘আমিও তোমার মতোই সংগ্রাম করছি, তবে সামনে কোনো সিনেমার কাজ করলে তোমাকে সঙ্গে রাখব।’ নাভেদ এটাকে সান্ত্বনা ভেবে আর খবর রাখেননি। কিন্তু ঠিকই আমাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানান, রয় সিনেমার ‘সুরাজ ডুবা হ্যায়’ নামে একটা গান করছেন। বাকিটা নাভেদের মুখেই শোনা যাক, ‘গানটিতে আমাল আমাকে পাশে চান। আমাকে একটা ডেমো পাঠান, যেখানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আরমান মালিক। যদিও মূল গানে কণ্ঠ দিয়েছেন অরিজিৎ। এরপর আমার অংশ করে পাঠাই। আমাল খুব পছন্দ করেন, আমার অংশসহ গানটি প্রকাশ পায়। গানটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।’
আশিকুর রহমানের পরের ছবি মুসাফির-এও তিনি নাভেদের সঙ্গে কাজ করতে চান। সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক ‘মুসাফির, পথ জানা নেই’ ও ‘ফিরে আয়’ গানের সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। এই সিনেমার টাইটেল ট্র্যাকের মাধ্যমেই ঢালিউড সিনেমায় প্রথমবার পাশ্চাত্য ঢঙে র্যাপের সংমিশ্রণ ঘটান। এরপর অস্তিত্ব, সুপারহিরো সিনেমার গানে তাঁকে সংগীত পরিচালক হিসেবে পাওয়া যায়। সে সময় পরিচালক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, তাঁর যদি একদিন সিনেমা ছাড়াও বেশ কিছু বিজ্ঞাপন ও নাটকের সংগীতায়োজন করেন তিনি।
এরই মধ্যে জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ঝুঁকি’টা নেন নাভেদ। যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। জুয়েল মোর্শেদসহ অনেক সংগীতশিল্পী ও অডিও কোম্পানির সহযোগিতা পান নাভেদ। দেশে যাত্রা শুরু করে তাঁর স্টুডিও। সংগীত পরিচালক হিসেবে সিনেমার বাইরে বাপ্পা মজুমদার, লিজা, মাহতিম শাকিবসহ অনেক সংগীতশিল্পীর একক গানে কাজ করতে থাকেন। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কোভিড। যুক্তরাষ্ট্রে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর মা–বাবা, সঙ্গে করোনায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখে ফিরে যান নাভেদ। পেশা বদলে শুরু করেন সফটওয়্যার প্রকৌশলীর চাকরি।
করোনার পর মুক্তি পায় পরাণ। রায়হান রাফী পরিচালিত সিনেমাটিতে নাভেদের সংগীত পরিচালনায় ‘চলো নিরালায়’ গানটি শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক সাড়া পায়। একটি নাটকের জন্য গানটি তৈরি হলেও সেখানে তা ব্যবহার করা হয়নি। রায়হান রাফী গানটি পছন্দ করলে সেটি পরাণ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে সিনেমার ‘জ্বলে রে পরাণ’ গানটিও আলোচিত হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক প্রকল্পে কাজ করতে থাকেন নাভেদ, এর মধ্যে প্রশংসা কুড়ায় তপু খান পরিচালিত লিডার: আমিই বাংলাদেশ সিনেমার ‘সুরমা সুরমা’, রায়হান রাফী পরিচালিত তুফান সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক এবং মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ওমর সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক।
পবিত্র ঈদুল আজহায় তাণ্ডব-এর ‘হবে তাণ্ডব’, ইনসাফ সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক ও আইটেম গানের সংগীত পরিচালনা করেন নাভেদ। বর্তমানে তাঁর একটি ইউটিউব প্রজেক্টে দেশ ও বিদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।