
বাংলা নাটক ও থিয়েটারের বিকাশে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে উৎপল দত্ত একজন। তিনি একজন বাঙালি অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যকার ও লেখক। ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রোপাগান্ডিস্ট।’ নিজের সম্পর্কে এভাবেই বলেছিলেন উৎপল দত্ত।
অবিভক্ত বাংলার বরিশালে উৎপল দত্তের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ। অভিনেতা, পরিচালক থেকে নাট্যকার হিসেবে বহুল পরিচিত উৎপল দত্ত ছিলেন বাংলার গণনাট্য আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। নাটকে রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলনই গণনাট্য আন্দোলন। গণনাট্যে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
তাঁর কাছে নাটক ছিল প্রতিবাদের ভাষা। হাতিয়ার হিসেবে তিনি নাটককে ব্যবহার করতেন। তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নাটকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন তিনি।
ছোট থেকেই ইংরেজি থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ ছিল তাঁর। কিন্তু বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর ক্যারিয়ার। একটা সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য শেক্সপিয়ারিয়ান্স’ নামের একটি থিয়েটার গ্রুপ। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। থিয়েটারের জন্য বহুবার জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর ইংরেজি থিয়েটারের দলটি ইংরেজি নাটকের সঙ্গে বেশ কিছু বাংলা নাটকও মঞ্চস্থ করে। নাটকের জন্য স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
উৎপল দত্তকে অনেকে বাংলা পথনাটকের পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৯২ সালে পর্যন্ত উৎপল দত্ত মোট ২৫টি পথনাটক করেছিলেন। কারখানার গেটে, নির্বাচনী জনসভায়, বন্দিমুক্তি আন্দোলনে উত্তাল বাংলার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে এসব পথনাটক প্রদর্শন করেন তিনি।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী। সাম্য ও সমান অধিকার নিয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই তাঁর একাধিক নাটকে দেখা যেত মার্ক্সবাদী ভাবনার প্রতিফলন।
উৎপল দত্তের নাটকগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা, ইতিহাস জ্ঞান ও মধ্যবিত্ত অনুভূতি। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা। আর ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’,‘দিল্লী চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটক ইতিহাস জ্ঞানের। ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত অনুভূতি তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।
‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটির নাম শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। আর এই সিনেমায় হীরক রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। এই চরিত্রে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি কৌতুক চলচ্চিত্র ‘গুড্ডি’, ‘গোলমাল’ ও ‘শৌখিন’-এ অভিনয় করেছেন।
নাট্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দীনবন্ধু পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। নাটক হলো দর্শক ও শিল্পীর মধ্যের এক সেতু। সাধারণ মানুষ পড়লে কিছু বোঝে না, দেখলে-শুনলে তারপর বোঝে, এমনটাই মনে করতেন নাট্যকার উৎপল দত্ত। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই নাট্যকার।