১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ অস্কার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়
১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ অস্কার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়

৮০ টাকা বেতনে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি, এরপর যেভাবে বিশ্বখ্যাত নির্মাতা হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ

আজ বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের চলে যাওয়ার দিন। ১৯৯২ সালের এই দিনে তাঁর পৃথিবীর ভ্রমণ শেষ হয়। চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তিকে নিয়ে প্রথম আলোয় বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়েছে আগে। তারই একটি আবার পড়ুন।

বেঁচে থাকলে আজ ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তপসে, জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলীর মতো জনপ্রিয় চরিত্রের স্রষ্টা, তীক্ষ্ণধী লেখক, সংগীতজ্ঞ, নকশাবিদ এবং বিশ্বচলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের অন্যতম চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বয়স হতো ১০৪ বছর।

সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা কবিতা ও শিশুসাহিত্যের সেরা লেখকদের একজন। দক্ষ চিত্রকর ও সমালোচক হিসেবেও সুকুমার রায়ের খ্যাতি ছিল। সত্যজিতের বয়স যখন তিন বছর, তখন তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। এরপর মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাঁকে লালন–পালন করেন।

বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়ার আগে কলকাতার বিমানবন্দরে সুপ্রিয়া, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়

সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছিলেন একজন নামকরা লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক ও প্রকাশক। উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনে ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে উপেন্দ্রকিশোরের পরিচিতি ছিল।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন সত্যজিৎ। বিশ্বভারতীতে পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও এর আগেই ১৯৪৩ সালে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় মাত্র ৮০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। ঘটনাচক্রে একই বছর প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তাঁর ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটির শুটিং করতে কলকাতায় আসেন। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে রেনোয়ার সহকারীর কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত পুরোপুরিভাবে এক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু করেন সত্যজিৎ। তবে ‘দ্য বাই সাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখার পরই বোধ হয় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় চিদানন্দ দাশগুপ্তসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি। সোসাইটির সদস্য হওয়ার পর থেকে সত্যজিৎ রায়ের অনেক বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা হয়। ১৯৪৯ সালে দীর্ঘদিনের পরিচিত বিজয়া দাসকে তিনি বিয়ে করেন। সত্যজিৎ-বিজয়ার ছেলে সন্দীপ রায়ও বর্তমানে একজন নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক।

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’। ১৯৫৫ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায় এবং সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এখনো এটি কালজয়ী সিনেমার তালিকায় রয়েছে।

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি। তাঁর পরের দুটি ছবি ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘পথের পাঁচালী’-এ তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে অপু ট্রিলজি হিসেবেই পরিচিত।

‘অপরাজিত’ ছবির সাফল্য সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারও জেতে ছবিটি। অপু ট্রিলজি শেষ করার আগে সত্যজিৎ রায় আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এর প্রথমটি ছিল ‘পরশপাথর’ নামের হাস্যরসাত্মক একটি ছবি। আর পরেরটি ছিল জমিদারি প্রথার অবক্ষয় নিয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো হচ্ছে ‘দেবী’ (১৯৬০), ‘তিন কন্যা’(১৯৬১) ও ‘অভিযান’(১৯৬২)।
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামের প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্যনির্ভর রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দার্জিলিংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায় একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে কাটানো এক বিকেলের কাহিনি নিয়ে জটিল ও সংগীতনির্ভর ছবিটি বানিয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’, যেটি ছিল তাঁর কর্মজীবনের সফল ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে উনিশ শতকের এক নিঃসঙ্গ বাঙালি বধূ চারু ও ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির কাহিনি বাস্তব জীবনের নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। ‘নায়ক’(১৯৬৬), ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’(১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’(১৯৭১) ও ‘জন অরণ্য’(১৯৭৫) ছবিও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অগ্রগণ্য।

সত্যজিৎ রায়

বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ প্রেমচাঁদের গল্পের ওপর ভিত্তি করে হিন্দি ভাষায় এক ঘণ্টার একটি ছবি বানিয়েছিলেন ‘সদগতি’ নামের।

‘পথের পাঁচালী’-র শুটিংয়ে মিচেল ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে সত্যজিৎ রায়

১৯৮৩ সালে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। এরপর তাঁর কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। এই ছবিতেই সত্যজিৎ প্রথমবারের মতো একটি চুম্বন-দৃশ্য যোগ করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর শেষ তিনটি ছবি প্রথম দিকের ছবিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সংলাপনির্ভর ছিল। ছবিগুলো হচ্ছে ‘গণশত্রু’(১৯৮৯), ‘শাখাপ্রশাখা’(১৯৯০) ও আগন্তুক’(১৯৯১)। ১৯৯২ সালে হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা নিয়ে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তাঁর। ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন।

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। তাঁর কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

শুটিং স্পটে সত্যজিৎ রায়

চলচ্চিত্রমাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ণ, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনি লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাঁকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন প্রদান করে। মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। এনডিটিভি অবলম্বনে পুনঃপ্রকাশ