অপূর্ণ থেকে গেল তাঁর ইচ্ছেগুলো

এ টি এম শামসুজ্জামান
সংগৃহীত

বর্ষীয়ান অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের শেষ ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ থেকে গেল। তিনি চেয়েছিলেন, মনের মতো একটি ছবি বানাবেন। সেই ছবির গল্পও তাঁর লেখা ছিল। একটু সুস্থ হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চিত্রনাট্য লেখার। এ ছাড়া শেষের দিকে তাঁর ইচ্ছে ছিল শেষবারের মতো অভিনয় করবেন। ক্যামেরার সামনে আর দাঁড়ানো হলো না। সিনেমা বানানোও হলো না। চলে গেলেন তিনি সবাইকে ছেড়ে।

চিত্রনায়িকা মৌসুমী এই প্রয়াত অভিনেতার কাছে একটি চিত্রনাট্য চেয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আর চিত্রনাট্য নেওয়া হয়নি এই অভিনেত্রীর। এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। কিন্তু নিজের জন্য শেষ চিত্রনাট্যটি আর লেখা হলো না এই অভিনেতার। গত বছর অক্টোবর মাসে এই অভিনেতার স্ত্রী রুনি জামান প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, এ টি এম শামসুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা, মনের মতো একটি গল্প লিখবেন। সেই গল্প দিয়ে নিজেই নির্মাণ করবেন সিনেমা। শিগগিরই তাঁর চিত্রনাট্য লেখার কাজেও হাত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছবি বানানোর কোনো টাকা তাঁর ছিল না। ছবির বানানোর কথা অনেকের কাছেই বলছিলেন। কোনো সাড়া পাননি। সর্বশেষ এই অভিনেতা পরিকল্পনা করেছিলেন সরকারের কাছে টাকা চাইবেন।
এই অভিনেতার স্ত্রী রুনি জামান গত জানুয়ারি মাসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘তিনি ছবি বানানোর ঘোরেই থাকেন সব সময়। কেউ শেষ ইচ্ছের কথা জিজ্ঞাসা করলেই তাঁর খারাপ লাগে। ছবিটা বানানো তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি প্রতিদিনই বলেন, মনের মতো ছবি বানিয়ে মরব।’

শিল্পী আব্দুল জব্বার, নায়ক রাজ্জাক এবং এ টি এম শামসুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

অভিনয় ছেড়ে কখনো দীর্ঘ সময় দূরে থাকেননি এই অভিনেতা। তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল অভিনয়। সেই অভিনয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর অসুস্থতা। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এ টি এম শামসুজ্জামানের অন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। সেই থেকে তাঁর দেহে বারবার অস্ত্রোপচার করা হয়। গত বছর শেষের দিকে যখন একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন, তখন তিনি চাইতেন অভিনয় করতে। কোনো নির্মাতা যদি নিরাপত্তা দিয়ে তাঁকে শুটিংয়ে নিয়ে যান তাহলে তিনি আবারও অভিনয় শুরু করবেন বলে জানিয়েছিলেন।

এ টি এম শামসুজ্জামান

রুনি জামান গত মাসে জানিয়েছিলেন, ‘৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত অভিনয় করেন। আগে কখনো অভিনয় থেকে এত দীর্ঘ বিরতি নেননি। অভিনয়ের মানুষ তিনি, অভিনয় ছাড়া থাকতে পারেন না। এফডিসি, লাইট, ক্যামেরার সঙ্গ এবং সহশিল্পীদের ছাড়া তাঁর ভালো লাগে না। এখন আবারও অভিনয় করার কথা বলেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আর কয়টা দিন দেখব, তারপরে আমার সিদ্ধান্ত নেব।’

গত বছর অক্টোবর মাসে এ টি এম শামসুজ্জামানকে দেখতে গিয়েছিলেন নায়ক ওমর সানী ও মৌসুমী দম্পতি। সে সময় সৌজন্য সাক্ষাতের পর হঠাৎ এ টি এম শামসুজ্জামানের কাছে মৌসুমী একটি চিত্রনাট্যের আবদার করেন। এই অভিনেত্রীর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা এ টি এম শামসুজ্জামানের স্ক্রিপ্টে ছবি বানাবেন। সেদিন তিনি মৌসুমীর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এই অভিনেতা খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন চিত্রনাট্য লেখা নিয়ে। মৌসুমীকে শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, তিনি শুধু বলবেন। সেটা শুনে লিখতে পারে, এমন একজন মানুষ পাঠাতে হবে। তিনি চেয়েছিলেন মৌসুমীর চিত্রনাট্য লিখবেন। কিন্তু অনেক দিন অপেক্ষার পরও এই অভিনেতার কাছে কেউ আসেনি। আক্ষেপ করে গত মাসে রুনি জামান জানিয়েছিলেন, মৌসুমীর জন্য চিত্রনাট্য লেখার কথা প্রায়ই তিনি বলতেন। কিন্তু পরে তাঁরা আর কেউ খোঁজ নেননি। তাঁরা লোক পাঠালে তিনি মৌসুমীর জন্য অবশ্যই লিখবেন। তাঁদের খুবই স্নেহ করেন তিনি।

এ টি এম শামসুজ্জামান
‘রঙের মানুষ’ নাটকের দৃশ্যে এ টি এম শামসুজ্জামান ও সালাউদ্দিন লাভলু।

দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি টানা বাসায় ছিলেন। ঘর থেকেও খুব একটা বের হতেন না। বই পড়া, টিভি দেখা, স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাতেন। আগে ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই নিয়মিত খবর নিলেও কয়েক মাস ধরে কোনো উপলক্ষ ছাড়া চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ তেমন একটা আসেননি। চলচ্চিত্রে পছন্দসই চরিত্রে অভিনয়ও করতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল। এ টি এম শামসুজ্জামান প্রায়ই বলতেন, তাঁকে নির্মাতারা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি।
অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান আজ শনিবার সকাল আটটায় রাজধানীর সূত্রাপুরে নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বাদ জোহর নারিন্দায় পীর সাহেববাড়ি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে এ টি এম শামসুজ্জামানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বাদ আসর সূত্রাপুর বাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।