
আলী যাকের ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী। বাংলাদেশে তিনি নবনাট্য আন্দোলনের অগ্রণীদের অন্যতম। ঢাকায় দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের তিনি পথিকৃৎ। অভিনয় ও নির্দেশনায় তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের পরিচয়। আজ এই গুণী অভিনয়শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির জন্মদিন। তিনি ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
আলী যাকেরের হাত ধরে উঠে এসেছেন বহু মুখ। তাঁরা এখন নাট্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে একজন অভিনেতা রওনক হাসান। তিনি গুরু ও প্রিয় মানুষকে নিয়ে আজ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল একজন মানুষ। যিনি একাই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। যার আশেপাশে চুপচাপ বসে থেকে তাঁর কথা শুনলেই মন প্রশান্তিতে ভরে যেত।’
রওনক আরও লিখেছেন, ‘এত বিশাল একজন মানুষ, যিনি এই অকিঞ্চিৎকর আমাকেও তাঁর স্নেহের ছায়ায় ভরিয়ে রাখতেন। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক যুবকের কাঁধে তিনি একদিন আশীর্বাদের, স্নেহের, ভালোবাসার হাত রেখেছিলেন। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙা গড়ায়, শিল্পের বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া এই আমার, চিরদিনের অনুপ্রেরণার আধার। আমার নাট্যগুরু, শিক্ষক, সহকর্মী, বন্ধু ছটলু ভাই, আলী যাকের!’
নাট্যচর্চার শুরু
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আলী যাকের শুরু করেছিলেন নাট্যচর্চা। শিল্প–সংস্কৃতির মানুষ হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধেও অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত নাটক ‘কবর’ দিয়ে মঞ্চনাটকে প্রথম অভিনয় শুরু তাঁর। এরপর প্রায় পাঁচ দশক মঞ্চে অভিনয় করেছেন তিনি।
অভিনীত নাটক
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘বিদগ্ধ রমণী কুল’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘গ্যালিলিও’র মতো মঞ্চনাটকে অভিনয় করে মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছিলেন এই প্রয়াত অভিনেতা। তাঁর অভিনীত নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজী চরিত্র বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এই তিনটি চরিত্রই আলী যাকেরের প্রিয় চরিত্র। শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল তাঁর, কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি।
শুধুই কি অভিনয়
মঞ্চনাটকে কেবল অভিনেতা নয়, একজন সফল নির্দেশকও ছিলেন আলী যাকের। তাঁর অভিনীত বেশির ভাগ নাটকের নির্দেশনা তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের দর্শক অর্থের বিনিময়ে নাটক দেখবে, এ ধারণা আগে ছিল না। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের একটা অংশ ছিল নাটক। অর্থের বিনিময়ে নাটকের চিন্তাটা প্রথম আসে আলী যাকেরের মাথা থেকে। আর অর্থের বিনিময়ে দর্শক মঞ্চে যে নাটকটি প্রথম দেখে সেটি ‘বাকী ইতিহাস’।
এখনো মনে পড়ে
মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আলী যাকের। তাঁর অভিনীত ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’ এখনো মানুষের কাছে জনপ্রিয়। বর্তমান সময়ে নাটকের মান নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সবাই মনে করিয়ে দেয় নব্বই দশকের এই নাটকগুলোর কথা। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখিও করতেন আলী যাকের। লিখেছেন অনেক মৌলিক নাটক, বই। একজন শৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবেও তাঁকে দেখা যায়।
মঞ্চে শেষবার
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর ‘গ্যালিলিও’ হয়ে শেষবারের মতো মঞ্চে উঠেছিলেন আলী যাকের। নাটক শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছু ভুলতে পারলেও ভুলতে পারি না এই মঞ্চ। যতবার নাটক নিয়ে মঞ্চে উঠি, প্রতিবারই যেন আমার পুনর্জন্ম হয়।’ এভাবেই মঞ্চের প্রতি তাঁর আবেগ ভালোবাসা প্রকাশ করেন এই অভিনয়শিল্পী। দেশ স্বাধীনের পর দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন গঠনে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন আলী যাকের। এই অভিনেতা বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। কিন্তু করোনার কাছে হার মানতে হয়। ২০২০ সালে ২৭ নভেম্বর মারা যান তিনি।