Thank you for trying Sticky AMP!!

বইমেলা নিয়ে একটি (অ)বৈজ্ঞানিক গল্পকাহিনি

বইমেলায় ঢুকতেই সন্ধ্যা নেমে এল। গেটে পুলিশকে নিজের শরীর গছিয়ে ভেতর দিকে উঁকি দিচ্ছি, হঠাৎ পাশের সারিতে একটা পরিচিত মুখ। পরিচিত কিন্তু ধরতে পারছি না কে! অথচ এত চেনা চেনা লাগছে। পুলিশ আমাকে যখন ছাড়ল, মুখটা তখন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমিও ঢুকে গেলাম ভেতরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কানে আওয়াজ এল—একটা কিনলে একটা ফ্রি...একটা কিনলে একটা ফ্রি...!

কাছে যেতেই দেখি, একটা বইয়ের স্টল আর তার সামনে আলখেল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছেন...দূর, এ-ও হয় নাকি! আমি চোখ কচলালাম। নাহ্, সত্যি! আলখেল্লা পরে সাদা দাড়ি-চুলে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তাঁর পেছন থেকে বই বিক্রেতা ঘোষণা দিচ্ছেন—একটা কিনলে একটা ফ্রি!

বিক্রেতার এক হাতে সঞ্চয়িতা, আরেক হাতে গীতবিতান। মানে কী? কবিগুরুর একটা বইয়ের সঙ্গে আরেকটা বই ফ্রি দিচ্ছে?

: গুরু, একি দশা?

: এখানে এত যে মশা...

বলেই গুরু নিজের কপালে একটা চাটি মারলেন।

: আপনার বই...একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি?

: তাতেই তো বেড়েছে বিক্রি...!

: কিন্তু বিক্রি-বাট্টার জন্য আপনি একটা বইয়ের রাখবেন না দাম?

: সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম!

তখনই সৈয়দ মুজতবা আলী এলেন হন্তদন্ত হয়ে।

: গুরু শুনেছেন, মেলার নিয়মকানুন?

: আপনাদের নিয়ম...আপনারাই জানুন।

: না না, এতে আপনিও তো যুক্ত। মানে আটটা বাজলেই নাকি মেলা শেষ!

: নাহি ভয়, নাহি দ্বেষ...

: কী বলেন, গুরু? বাণিজ্য মেলাও নাকি চলেছে দশটা পর্যন্ত...

: আহা, বালতি যে বিকোয় বেশি বইয়ের তুলনায়। ওটাই বাণিজ্যের মন্ত্র! তবে, এ মেলায় একটাই প্রবলেম!

: কী গুরু? তাড়াতাড়ি বলেন। আপনার প্রবলেম শুনলে তো আমাদের ঘুম নাই!

: মেলার ভেতর কোনো বাথরুম নাই!

: আসলে হয়েছে কী...

বলতে না–বলতেই আরেক পাশে হইচই। দেখি একটা বইয়ের স্টলে শরৎচন্দ্র দাঁড়িয়ে। শরীরে সাদা চাদর জড়িয়ে, পাকা চুল নেমে এসেছে কিছুটা কপালে। চেহারায় এক অদ্ভুত কাঠিন্য। তাঁকে ঘিরে অনেক মানুষ।

সবাই অটোগ্রাফ চায়। সেলফি তুলতে চায়। এর মধ্যে হাতে পানীয়র বোতল নিয়ে দেবদাস সেজে ঢুকে পড়েছে একজন। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এরই কোন ফাঁকে এক রিপোর্টার নিচ্ছে সাক্ষাৎকার।

: শরৎবাবু, খোলাচিঠি দিলাম তোমার কাছে...

: মানে কী, গান কেন?

: আনন্দে, স্যার। আপনি এত জনপ্রিয়! আপনার দেবদাস আর শ্রীকান্ত আসছে আর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলছে, বাজারে এখন চিপসের থেকেও বেশি আপনার বই বিক্রি হয়...এ ব্যাপারে আপনার কী মত?

: মত একটাই। আর মেলায় এভাবে আসা যায় না। লোকে খামচায়, পাড়া দেয় পা। গতকাল পার্বতী সেজে এক মেয়ে এসে তিন ঘণ্টায় প্রায় তিন লাখ সেলফি তুলেছে আমার সঙ্গে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ ব্যথা, ঘাড় ত্যাড়া হয়ে গেছে! আমার চেয়ে নিভৃতচারীরাই ভালো!

: কাদের কথা বলছেন?

: নাম নেওয়া যাবে না। নাম নিলে ঝামেলা হয়ে যাবে, বোঝেন না!

হঠাৎই দেখলাম ওই ভিড়ের মধ্যে আমার প্রায় পরিচিত মুখটা। বড় বড় চোখ। কিন্তু কেমন বোকা বোকা চেহারা। যেন এই দিন-দুনিয়ার কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। কার সঙ্গে এই চেহারার মিল যেন? মিলিয়ে গেল মুখটা। আমিও সরে এলাম একটু অন্যদিকে। দেখি বসে আছেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক, তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ। আমাকে দেখেই তারাশঙ্কর তুড়ি বাজিয়ে ডাকলেন, ‘ওহে ছোকরা, এদিকে এসো তো দেখি...’

: জি?

: কী নিয়ে ওদিকে হ্যাপা, অ্যাঁ?

: শরৎচন্দ্র এসেছেন তো! সবাই অটোগ্রাফ নিচ্ছে, ছবি তুলছে।

মুহূর্তেই দেখি তিনজনের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তারাশঙ্কর নিজের ঘাড়ের উত্তরীয়টা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা আমাকে প্রাইজ দিয়েছে আজকে অনুষ্ঠানে, জানো?’

: কবি উপন্যাসে নিতাইকেও না এ রকম একটা উত্তরীয় প্রাইজ দিয়েছিল?

মানিকবাবু বললেন, ‘আজকালকার এই ফেসবুক জেনারেশনরা একটু বেশিই বাচাল। সব সময় ফটর ফটর করে কথা বলে!’

বিভূতিভূষণ বললেন, ‘এসব রাখো তো। আমি অরণ্যে একটা সেলফি তুলব বলে সকাল থেকে সেজেগুজে এসেছি। কোথায় অরণ্য আর কোথায়ইবা সেলফি!’

: আপনার মোবাইল ফোন দিয়েই তো সেলফি তুলতে পারেন?

: সেকি! আমাদের আবার স্মার্টফোন আছে নাকি? ভাবলাম, ফ্যানট্যানরা তুলে দেবে...তোমার আছে, স্মার্টফোন?

আমি পড়লাম মহা বিপদে। ‘আছে’ বললেই যদি ধরে নিয়ে সেলফি তোলাতে শুরু করে! আমি বললাম, ‘আজ্ঞে আছে। কিন্তু ফোনে চার্জ নাই!’

: তোমাদের মনেও চার্জ নাই! পুরা জেনারেশন চার্জলেস। এক মাইল হাঁটতে তোমাদের জিব বের হয়ে আসে, এক থালা খেলে তোমাদের পেট নেমে যায়, একটা উপন্যাস লিখতে তোমাদের ঘাড় ভেঙে যায়! স্যাড, ভেরি স্যাড!

ঠিক তখনই সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম এসে হাজির। তাঁর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য টাইপের অবস্থা! বাঁশিতে একটা ছোট্ট ফুঁ দিয়ে বললেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত...!’

বিভূতিভূষণ ফোড়ন কেটে বললেন, ‘হায় রে, বাসায় যদি শুধু তা জানত!’

তারাশঙ্কর বললেন, ‘বসো। কে আছিস, আরেকটা চেয়ার আন তো!’

: আমি যুগে যুগে আসি... আসিয়াছি মহা পুনঃবিপ্লব হেতু...

: ইশ্, আর কবিতা পোড়ো না তো! বইমেলাজুড়ে শুধু কবিতারই বই! হাজার হাজার বই, লাখ লাখ কবিতা!

: পড়েছেন কি সবই তা?

: পড়ব কেন? দেখেই বোঝা যায়, ওসব পড়ার অযোগ্য!

মানিকবাবু বললেন, ‘সবই অযোগ্য, তা বলাও ঠিক নয়। কিন্তু এত বাজের মধ্যে ভালো বের করা খুব কঠিন হয়!’

নজরুল বললেন, ‘ওটাই পাঠকের কাজ! ভালো নেই ভালো নেই বলে তাই বাড়াবেন না কপালের ভাঁজ!’

: কিন্তু গল্প কই? উপন্যাস?

: আর শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, বই তো চাই বারো মাস!

: শুধু শুধু হইচই! ছোটদের বই কই! তাদের জন্য সাহিত্য নাই কোনো। যেন তাদের জন্য শুধু পড়া আর পড়া, কিঞ্চিৎ ঘুমও আছে!

তখনই এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে রবীন্দ্রনাথ এসে বললেন, ‘আচ্ছা, এদিকে কি কোনো বাথরুম আছে?’

নজরুল বললেন, ‘গুরু, আপনাকে সালাম। আমি তো বাংলা একাডেমির ওদিকটা থেকে সেরে আসলাম!’

: হুম্, এইটা সত্যি খুবই প্যাথেটিক!

অন্যরা এবার একসঙ্গে বললেন, ‘ঠিক ঠিক ঠিক!’

এর মধ্যেই হঠাৎ করে মেলার আলো নিভে গেল। কে যেন চিৎকার করে বললেন, ‘ওই যে আটটা বেজে গেছে। মেলা ফুরাল...আটটা মানে আটটা!’

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, রাস্তার পাশে বসে আছে সেই পরিচিত মুখ। বড় বড় চোখ। লোকটা খপ করে আমার হাত ধরে বলল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’

আমি তো ভয়ে কেঁপে উঠলাম। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইলে লোকটা বলে উঠল, ‘ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে!’

আচ্ছা তো, আমি কেন যুবকের সঙ্গে কথা বলব! আমার তো রংধনু প্রবলেম নাই। লোকটার হাত ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম। তখনো মনে হচ্ছিল, ওই লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি! কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারলাম না!