Thank you for trying Sticky AMP!!

সতীদাহ প্রথার বিলোপ

১৯ শতকের চিতকলায় সতীদাহ প্রথা

সতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানবিক প্রথা। কোন সময় সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪ শতকে দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে। তা ছাড়া পৌরাণিক কাহিনিগুলোয় এমন আত্মাহুতির অনেক উদাহরণ রয়েছে।

‘সতী’ শব্দটি এসেছে দেবী সতীর নাম থেকে। রাজা দক্ষের কন্যা ও দেবতা শিবের স্ত্রী তিনি। রাজা দক্ষ সতীর সামনে শিবকে তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেতে তিনি আত্মাহুতি দেন। তা ছাড়া মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে সহমরণের এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সতীদাহের আদেশ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এমন অনেক নারী চরিত্র আছেন, যাঁরা স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। ধর্মগুরুরা এসব পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করেছেন সতীদাহ প্রথার নামে নারী হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে।

সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন। তা ছাড়া ছেলে মারা যাওয়ায় তাঁর স্ত্রীকে বাড়িতে রাখা ঝামেলা মনে করা হতো। হত্যাই যেন এর সহজ ও একমাত্র সমাধান ছিল! বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই প্রথাচর্চার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল।

ঢাকঢোল, শঙ্খ, ঘণ্টা ইত্যাদির আওয়াজ আর চারপাশের মানুষের হইহল্লার আড়ালে চাপা পড়ে যেত বিধবার কান্নার শব্দ। বিধবা নারীকে নববধূর মতো সাজিয়ে, সিঁদুর ও ফুলের মালা পরিয়ে, চন্দন ও আলতার রঙে রাঙিয়ে জ্বলন্ত চিতার ওপর তুলে দেওয়া হতো। অনেক সময় আফিমজাতীয় মাদকদ্রব্য খাইয়ে বা মাথার পেছনে আঘাত করে অজ্ঞান করে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় তুলে ভস্ম করে দেওয়া হতো। চিতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে আঘাত করা হতো এবং ঠেলে দেওয়া হতো আগুনের ভেতর।

শত শত বছর ধরে চলে আসা এই নৃশংসতম প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তাঁর সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তাঁর লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না।

১৭৯৯ সালে খ্রিষ্টান যাজক ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক উইলিয়াম কেরি এই প্রথা বন্ধের প্রয়াস নেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তিনি সতীদাহ বন্ধের আবেদন জানান। এরপর রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ও তাঁর লোকেরা বিভিন্নভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং তা শাস্ত্র ও আইনবিরুদ্ধ। ১৮২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ শিরোনামের ছোট একটি পুস্তিকা।

১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি সতীদাহ প্রথার কথা আগে থেকেই জানতেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের যুক্তির সারবত্তা অনুভব করে আইনটি পাসে উদ্যোগী হন। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন।

খ্রিষ্টান মিশনারি, ব্রাহ্ম সমাজ ও প্রগতিশীল হিন্দুরা তাঁর পাশে দাঁড়ালেও হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা এই আইনকে হিন্দু ধর্মের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করেন। সমাজের ধর্মীয় রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ‘ধর্মসভা’ গঠন করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিলও করেন। আপিলে অংশ নিতে দিল্লির বাদশাহ আকবরের সহায়তায় রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে যান। বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, পুরাণ থেকে যুক্তি দেখিয়ে তিনি প্রিভি কাউন্সিলে প্রমাণ করেন, সতীদাহ প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, উপরন্তু এটি হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রবিরোধী। ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল রক্ষণশীল হিন্দুদের আপিল খারিজ করে লর্ড বেন্টিঙ্কের আদেশ বহাল রাখেন। এই বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর ভারতবর্ষ থেকে সতীদাহ প্রথা পুরোপুরি বন্ধ করতে আরও তিন দশক লেগে যায়।