কাঁদতে মন চায় কিন্তু পারি না

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রশ্ন: আমি একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, বয়স ১৭। আমার পরিবারে বাবা, মা, বোন, দাদি আর চাচা–চাচি আছেন। আামাদের পরিবারে মা এবং দাদির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে। ঠিক কেন জানি আমার মাকে দাদি দেখতে পারেন না। তাই কিছু কিছু সময় বাসায় চিৎকার করেন আমার দাদি। এ রকম ব্যাপার আমি এখন আর ঠিক নিতে পারি না। আমি কোনো কিছু খারাপ লাগার ব্যাপার চিন্তা করলে খুব অস্থির হয়ে পড়ি। ঠিক বুঝতে পারি না কী করব। মনে হয় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আর মন চায় এমন কোথাও যাই, যেখানে কোনো মানুষ থাকে না। কিন্তু করতে তো পারি না। তাই তখন খুব মাথাব্যথা করে। আবার মা আমার প্রতি অনেক কড়া। এমনিতে ভালোই কাটে কিন্তু একটা কিছু ভুল হলেই আমার ওপর চিৎকার–চেঁচামেচি করেন। হয়তো যেটা বলা প্রয়োজন না, এমন কথাও বলেন। পুরোনো একটা ভুলকে সব সময় তুলে ধরেন। আমি না বুঝে একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিলাম কিন্তু সেখান থেকে আমি সরে এসেছি। তবু মা এটা নিয়ে কথা শোনান। শুনলে অনেক খারাপ লাগে, মনে হয় আমার জীবনটাই কেন আছে। তখন আমার কেমন লাগে, ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। আবার এ রকমও হয় যে স্বাভাবিক আছি, হঠাৎ করে কেমন জানি লাগে বুঝতে পারি না। খুব খারাপ লাগে। মনে হয় কেন বেঁচে আছি। মাঝেমধ্যে কাঁদতে মন চায় কিন্তু পারি না। বিষণ্ন লাগে মাঝেমধ্যেই। কেন বিষণ্নতা কাটে না, বুঝি না। আবার মাথায় এই চিন্তা ঘোরে যে আমি হয়তো পড়াশোনা করতে পারব না।

এইচএসসিতে হয়তো ফেল করব। কোনো পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না। মনে হয় যে মা হয়তো আমাকে বেশি চাপ দেন। আমি কোথাও যেতে চাইলে সেখানে যেতে দেন না। তখনো অনেক খারাপ লাগে। কী করব বুঝতে পারি না। এর জন্য আমার পড়াও ঠিকভাবে করতে পারি না। তাই সাহায্য চাইছি।

নাফিসা, পাটগ্রাম

উত্তর: তুমি যে কতটা অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে দিনগুলো পার করছ, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। যে বাড়িতে বড় হয়েছ, সেখানে যে সারাক্ষণ একটি অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে, তার একটি বর্ণনা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শাশুড়ি-বউয়ের দ্বন্দ্ব নিয়মিতই দেখা যায়। তোমাদের পরিবারটিও তার ব্যতিক্রম নয়। দাদি যখন মায়ের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করেন, তখন তোমার বাবার ভূমিকা কী থাকে জানাওনি। তিনি কি নিজের মাকেই সাপোর্ট করেন, নাকি তোমার মায়ের প্রতিও কিছুটা সহমর্মী থাকেন? এ ছাড়া দাদি কি চাচির সঙ্গেও একই আচরণ করছেন, নাকি শুধু তোমার মায়ের প্রতিই বীতশ্রদ্ধ, জানতে পারলে ভালো হতো। কেবল তোমার মায়ের সঙ্গেই সেটি ঘটে থাকলে তুমি ভেবে দেখতে পারো, এটি দাদি কী কী কারণে করে থাকতে পারেন। তোমার মায়ের কিছু আচরণ সংশোধনের প্রয়োজন থাকলে তুমি কোনো এক মুহূর্তে মাকে বুঝিয়ে বলতে পারো, কীভাবে তিনি নিজের কিছু আচরণ পরিবর্তন করতে পারেন।

তোমার যখন দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা হয়, খুব কষ্ট হতে থাক, তখন হয়তো কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। তাই প্রতিদিন দিনে দুবার, যে সময় তুমি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকো, বড় করে নাক দিয়ে নিশ্বাস গ্রহণ করে কিছুক্ষণ ধরে রেখে একটু সময় নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়বে। ইউটিউবে ইংরেজিতে ‘৪–৭–৮ ব্রিদিং’ লিখলে এই পদ্ধতিটি কীভাবে করতে হয়, তা দেখে নিতে পারবে। এটি প্রতিদিন দুবার করে বা চারবার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামটি করলে প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব হবে। এই চর্চাটি কেন আমাদের সহায়ক, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটিও ইন্টারনেটে দেওয়া রয়েছে।

অল্প বয়সে তুমি যে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলে, বয়ঃসন্ধিকালে সেটি অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। তবে যে কেবল নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছ, সেটি সত্যিই খুব প্রশংসনীয়। এ ছাড়া মা যে তোমার প্রতি সহমর্মী হতে পারছেন না, তার কারণ কি তিনি নিজেও প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন বলে? দাদি যখন মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, তখন বাবা যদি কিছুটা হলেও তাঁকে মানসিকভাবে সহায়তা না করেন, তাতে মায়ের কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি নিজেও মনে হচ্ছে ভালো নেই এবং বিষণ্নতায়ও ভুগছেন। আর সেই বিষণ্নতার কারণে তাঁর যখন রাগ হচ্ছে, তখন তিনি হয়তো তোমার ওপরেই সেই রাগ না চাইতেও প্রকাশ করে ফেলছেন। হয়তো নিজেও পরে অনুতপ্ত হচ্ছেন, কিন্তু তোমাকে সেই কথাটি বলতে পারছেন না। তুমি কি মাকে একটি চিঠি লিখে জানাতে পারো যে এই সংসারে থেকে মায়ের যে অনেক কষ্ট হচ্ছে, তা তুমি বুঝতে পারো? সত্যিকার অর্থেই তাঁকে তুমি খুব ভালোবাসো। কিন্তু তাঁর রূঢ় আচরণের কারণে তোমার মনে অনেক কষ্ট আর অভিমান জমে যায়।

তুমি এটি লিখতে পারো যে এই পরিবারে তোমরা দুজনেই খুব দুঃখী এবং মা যদি তোমার প্রতি আর একটু সহানুভূতিশীল হতে পারেন, তাহলে তোমরা দুজনেই দুজনের জন্য সহায়ক ভূমিকায় থাকতে পারবে। চিন্তা করে দেখো, এটি করা সম্ভব কি না। সামনে এখনো তোমার অনেক কিছু করার আছে। এখনই হাল ছেড়ে দিয়ো না, কেমন? মায়ের সঙ্গে আরও একটু ভালো সম্পর্ক তৈরি করে এগিয়ে গেলে অবশ্যই একসময় তোমার আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা কিছুটা হলেও ঘটাতে পারবে।