Thank you for trying Sticky AMP!!

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর

বহুদিন পর পুরোনো সেই মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (সামনে, চোখে সানগ্লাস)

সকালের শীত তখনো বেশ আরাম ছড়াচ্ছে। আরামবাগ থেকে মতিঝিল যেতে যেতে কানে এল গানের সুর। গানের উৎস খুঁজতে ডানে তাকাতেই চোখে পড়ে সাজানো তোরণ।

নটর ডেম কলেজের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমাদের দেশে যে কোনো অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু দেরিতে শুরু হওয়ার ‘রেওয়াজ’ আছে। নটর ডেম কলেজের ছাত্ররা অবশ্য কখনোই এই রেওয়াজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর অনুশাসনের যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে, সম্ভবত সেটাই সবাইকে সময়মতোই টেনে এনেছিল ছুটির দিনের এই সকালবেলায়। গত শুক্রবার।

প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টায়। ৮০ ভাগ উপস্থিতি না থাকলে প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয় না। কখনো নিয়ম শিথিলযোগ্য হয়, তা-ও কোনো ধরনের কায়িক শ্রম কিংবা লাইব্রেরিতে লেখাপড়া করার শাস্তির বদলে। সপ্তাহে একবার কুইজ, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের ব্যবহারিক, লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রম। দুই বছরের নটর ডেমের জীবনটা মোটামুটি সব বর্ষের ছাত্রদের জন্য একই নিয়মের সুতোয় বাঁধানো বলেই হয়তো এখানে বিভিন্ন বছরের প্রায় কয়েক হাজার ছাত্রের গল্পের ধরনগুলোও একই রকম মনে হলো।

সারা দিনের হইহল্লা, কিছুক্ষণ পর পর এখানে–ওখানে ছবি তোলার মধ্যেও কলেজজুড়ে বিভিন্ন প্রাক্তন ছাত্ররা, যাঁদের মধ্যে বর্তমানে অনেক রথী–মহারথী ক্ষমতাধর মানুষ রয়েছেন, সবাই যেন নিজ নিজ সময়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়ে ছিলেন। খাবারের সারিতে দাঁড়ানো, উপহার সংগ্রহ, কিংবা সামান্য চা নেওয়ার জন্যও সেই চেনা, সারিবদ্ধ শৃঙ্খলার ছায়া। এখানে কে হোমড়াচোমড়া গাড়িতে করে এসেছেন, কে এসেছেন রিকশায়, তাতে কী যায় আসে!

অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে পুরোনো ছাত্রদের গল্পের একটা বড় অংশে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের প্রয়াত টেরেন্স পিনেরো স্যার, যিনি ছাত্রকল্যাণ বিভাগও দেখতেন। স্যারের শাস্তি, কিংবা অনেক ভয়ভীতির পরেও কলেজ ছাড়ার আগে বা কলেজে পড়ার সময়ে স্যারের যে উপদেশমিশ্রিত স্নেহ প্রতিটা নটরডেমিয়ান পেয়েছেন, জীবনের চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়েছে তা। বিভিন্ন সময়ে নটর ডেমের বিভিন্ন শিক্ষক, কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ফাদার জন হ্যারিংটন থেকে শুরু করে বর্তমান অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিয়ুস রোজারিও—সবাই কলেজের মানদণ্ড একই উচ্চতায় ধরে রেখেছেন।

এই আয়োজনে শরিক ছিলেন প্রাক্তন নটরডেমিয়ানদের পরিবারের সদস্যরা। অনেকেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে এসেছিলেন প্রিয় কলেজ প্রাঙ্গণে৷ পুরো কলেজে সাজ সাজ উৎসবের আয়োজনে অংশ নিতে পেরে সবাইকেই উচ্ছ্বসিত মনে হলো। বেশ কয়েকজনের দেখা মিলল, যাঁদের পারিবারিক কলেজই নটর ডেম। পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই এমনকি চাচা-ভাতিজা আর মামা-ভাগনের দেখাও পাওয়া গেছে এই মিলনমেলায়। প্রজন্মের পর প্রজন্মের এই সেতুবন্ধনের মেলায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এরই মধ্যে অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চ থেকে কখনো কবিতাপাঠ, কখনো দেশাত্মবোধক গান, কখনো আধুনিক গান, কখনো রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে বিভিন্ন শিল্পীদের, যার অধিকাংশই কলেজের ছাত্র বা তাঁদের পরিবারবর্গের কেউ। এরই মধ্যে ছিল যাত্রার আয়োজন।

সন্ধ্যা নামতেই শোরগোল শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গান শোনাতে মঞ্চে আসবেন দেশের স্বনামখ্যাত তাহসান ও বাপ্পা মজুমদার, দুজনই এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র৷ এরই মধ্যে কারও কারও যাওয়ার সময় হলো। মিলনমেলা ভাঙতে গিয়েও যেন ভাঙছিল না৷ কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বিদায় নিয়ে ‘চল এক কাপ চা খেয়ে যাই’ বলে আবারও ঘণ্টাখানেকের আড্ডায় মশগুল হলেন অনেকেই। আড্ডাটাই এখানে আসল, চা তো কেবল ছুঁতো!

ব্যস্ত এই শহরে কাছাকাছি থেকেও দেখা হয় না অনেকের। একদিনের জন্য সব ব্যস্ততাকে অবসরে পাঠিয়ে কৈশোরে ফিরে যাওয়ার দিনটা মনে নিয়েই হয়তো বছরের শুরুতে সারা বছরের মনের খোরাক নিয়ে ফিরে গেলেন অনেকে।

সামনের শীতে হয়তো আবার দেখা হবে, এই প্রত্যাশায়।

লেখক: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নটর ডেম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র