আমরা খেলার পাগল

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ক্রীড়াপ্রেমী শিক্ষার্থীরা এক হয়ে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন ফ্যান ক্লাব, ফেসবুক গ্রুপ। তাঁদের খোঁজখবর নিয়েছেন ফুয়াদ পাবলো

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

স্পোর্টস ফ্রিকস অব বুয়েট

আগস্ট ২০১৮। কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ, সামনেই শুরু হবে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল। ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে তখনো আমাদের দেশে খুব একটা মাতামাতি শুরু হয়নি। এমনই একটা সময়ে বুয়েটের ২০১৭ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে খুললেন ফ্যান্টাসি ফুটবলবিষয়ক একটি আন্তবুয়েট ফেসবুক গ্রুপ।

এরপর এক বছর কেটে গেল। শুরু হলো ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ-জ্বরে কাঁপতে লাগল ক্রিকেটবিশ্ব। সেই জ্বরে কাঁপতে কাঁপতেই ওই খেলাপাগল শিক্ষার্থীরা সব ধরনের খেলাধুলাবিষয়ক নিজস্ব একটা প্ল্যাটফর্মের অভাব বোধ করলেন। তাই বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই খোলা হলো ‘স্পোর্টস ফ্রিকস অব বুয়েট’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ। ২০১৭ ব্যাচকে দিয়ে শুরু হলেও এরপর গ্রুপে যুক্ত হলেন ২০১৬ ও ২০১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। কিছুদিন পর গ্রুপে যুক্ত হলেন নবীন শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাইরাও।

‘স্পোর্টস ফ্রিকস অব বুয়েট’–এ প্রকাশিত হচ্ছে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের নিজেদের লেখা ও অনুবাদ করা দারুণ সব ফিচার, ম্যাচ প্রিভিউ, ম্যাচ-পরবর্তী বিশ্লেষণ, খেলোয়াড়দের তথ্য ইত্যাদি। ধীরে ধীরে বাড়ছে জনপ্রিয়তা। বর্তমানে পেজটির অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার।

নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পডকাস্ট। লেখালেখি আর পডকাস্টের বাইরে পেজটি থেকে নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগ প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ফুটবল ও ক্রিকেটবিষয়ক আন্তবুয়েট কুইজ প্রতিযোগিতা।

‘স্পোর্টস ফ্রিকস অব বুয়েট’-এ প্রকাশিত লেখাগুলো নিয়ে নিজেদের ব্লগসাইট খোলার পরিকল্পনা আছে বলে জানালেন গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী তওসীফ তানজীম। তওসীফ বলেন, ‘এ বছর ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে বের করা হবে বিশেষ ম্যাগাজিন, আয়োজিত হবে কুইজ প্রতিযোগিতা। অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের মার্চেন্ডাইজ বের করার পরিকল্পনাও আমাদের আছে।’

স্পোর্টস ফ্রিকস অব জাহাঙ্গীরনগর

অনেক বিষয় নিয়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আলাদা কমিউনিটি থাকলেও খেলাধুলা নিয়ে তেমন কিছু ছিল না, বিশ্লেষণধর্মী নানা কনটেন্টের মাধ্যমে যেখানে খেলাটাকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝা যাবে। সেই অভাববোধ থেকেই করোনাকালীন বন্ধের সময়ে, ২০২০ সালের নভেম্বরে একটা উদ্যোগ নেন ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। শুরুতে নিজেদের ব্যাচের ফ্যান্টাসি ফুটবল গ্রুপে শুরু হয় আলোচনা। সেখান থেকেই জন্ম নেয় স্পোর্টস ফ্রিকস অব জাহাঙ্গীরনগর। এরপর থেকে প্ল্যাটফর্মটি বিশ্লেষণধর্মী নানা কনটেন্ট তৈরি করে যাচ্ছে।

২০২১ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ (ইউসিএল) ফাইনাল দিয়ে অনলাইনে পডকাস্ট শুরু করে স্পোর্টস ফ্রিকস অব জাহাঙ্গীরনগর। এসব পডকাস্টে অংশ নিয়েছেন ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র, ইয়াশ অরোরার মতো বিশ্লেষকেরাও। রাতের পডকাস্টে পেজের অ্যাডমিন ও মডারেটররা খেলাধুলা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করছেন।

শুধু যে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী আর বিশেষজ্ঞরাই এতে অংশ নেন, তা কিন্তু নয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখানে সাদরে আমন্ত্রিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়ামোদী শিক্ষার্থীরা অতিথি হয়ে যোগ দেন আলোচনায়।

প্ল্যাটফর্মটির অন্যতম উদ্যোক্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ সাকিব বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমরা আরও স্বনামধন্য অতিথিদের আমাদের প্রোগ্রামে যুক্ত করার চেষ্টা করব। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শর্টপিচ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল টুর্নামেন্ট চালুর ব্যাপারে আমরা কাজ করব বলে ভাবছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা–সংক্রান্ত আপডেটগুলো আমাদের পেজ ও গ্রুপে নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করব।’

স্পোর্টস সিইউ

মেধার সঙ্গে যদি পর্যাপ্ত ক্রীড়াজ্ঞান যোগ হয়, তাহলেই একটি দেশের ক্রীড়াঙ্গন ধারাবাহিকভাবে সফল হবে। এই উপলব্ধি থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ২০১৮ সালে শুরু করেন ‘স্পোর্টস সিইউ’। যাত্রা শুরুর সময় থেকেই এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি।

ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য স্কুলে স্কুলে ঘুরে নানা রকম প্রচারণা, স্পোর্টস সেমিনার, স্পোর্টস একাডেমি ওয়ার্কশপ, সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে ক্রীড়া কার্যক্রম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন, অনলাইন সেমিনার, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া কার্যক্রমের মতো নানামুখী কাজ করছে স্পোর্টস সিইউ।

খেলার সঙ্গে বিজ্ঞানের যে শাখাগুলো জড়িত, তা নিয়েও আলোচনা করা হয় নিয়মিত। এসব কর্মসূচিতে খেলাধুলার পাশাপাশি স্পোর্টস ফিজিওলজি ও স্পোর্টস অ্যানাটমি, স্পোর্টস নিউট্রিশন, স্পোর্টস ট্রেনিং নিয়েও ধারণা দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং স্পোর্টস সিইউ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আসাদুজ্জামান নুর বলেন, ‘খেলাধুলার উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে যেতে চায় স্পোর্টস সিইউ। তা ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের নিয়েও আমরা কাজ করতে চাই।’

আরইউ ফুটবল ফ্যান বেজ

ফুটবলের প্রকৃত রোমাঞ্চ তো তখনই অনুভব করা যায়, যখন বিভিন্ন দলের সমর্থক একটি প্ল্যাটফর্মে এক হয়ে তর্ক-বিতর্ক কিংবা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সুযোগ করে দিয়েছে ‘আরইউ ফুটবল ফ্যান বেজ’। দলটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল–সংক্রান্ত দলগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় এবং সক্রিয়। শুরু থেকেই ক্যাম্পাসের ফুটবল ভক্তদের নিয়ে ‘ফুটবল আড্ডা’র আয়োজন করে আসছে তারা। এ ছাড়া বিভিন্ন টুর্নামেন্ট সামনে রেখে থাকে নানা ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। এই যেমন ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বিভিন্ন দলের নামে সমর্থক কমিটি করা হয়েছিল। ফুটবলের বড় ম্যাচগুলো একসঙ্গে উপভোগের জন্য আয়োজন করা হয় বারবিকিউ পার্টি। ম্যাচের ফলাফল অনুমানের প্রতিযোগিতা, ফিচার লেখার প্রতিযোগিতা, সাবেক খেলোয়াড়দের পরিচিতিপর্ব, থাকে এমন নানা আয়োজন।

ফুটবলপ্রেমীদের এই দলের অন্যতম উদ্যোক্তা শরীফ মাহমুদ বলেন, ‘একটা মিলনমেলা করার পরিকল্পনা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ছাড়াও ফ্রেন্ডশিপ ম্যাচ আয়োজন, বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন, ক্রীড়াবান্ধব পরিবেশ তৈরি, সেই সঙ্গে সামনের বিশ্বকাপে কিছু ইভেন্ট আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে।’