
আমার মেজ আপা, আসমা কিবরিয়ার কথা লিখতে বসেছি। কোথা থেকে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। এত স্মৃতি, এত কথা মনে জ্বলজ্বল করছে। আসমা আপার মতো এমন বড় বোন সবার ভাগ্যে জোটে না, শুধু বোন বললে ভুল হবে, তিনি ছিলেন আমার মায়ের তুল্য। মাত্র ১০ বছর বয়সে আমি মাকে হারিয়েছি। মেজ আপা সব সময় আমার সে অভাব পূরণে সহায়তা করেছেন।
ছয় বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট, তাই মেজ আপার সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধানটা বেশিই ছিল। ছেলেবেলায় তিনি প্রায়ই আমাদের খাওয়াতেন, গল্প শোনাতেন, বেণি বেঁধে দিতেন। বিয়ের পর আপাকে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকতে হয়, কিন্তু যখনই তিনি ঢাকা আসতেন, অপার স্নেহে ছোট বোনদের কাছে টেনে নিতেন।
মেজ আপার কথা বলতে গেলে আরেকটি নাম এমনিতেই এসে যায়, তিনি আমার মেজ দুলাভাই বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। আপা ও দুলাভাইয়ের মতো এমন সুখী দম্পতি আজকাল দেখা যায় না। আপাকে তিনি সব সময় ছবি আঁকায়, গান গাইতে খুব উৎসাহ দিতেন। প্রায়ই তাঁরা দুজন কোনো উৎসবে, বনভোজনে বা ঘরোয়া দাওয়াতে পরিবারের সবাইকে একত্র করতেন, গানের জলসা বসত সেখানে। কানে আজও ভাসে আপা-দুলাভাইয়ের দ্বৈত কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীতের সেই সুর—
‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা।’
বা
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...’
তাঁতের সুতি শাড়ি ছিল আপার প্রিয় পোশাক। আমার জানামতে, তাঁকে কখনো আমি অন্য পোশাকে দেখিনি, শাড়ি পরতেই দেখেছি। নিজ ভাষা, সংস্কৃতির ওপর ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। প্রতিদিন তিনি বাড়িতে সুন্দর একটা তাঁতের শাড়ি পরতেন। কোথাও যাচ্ছেন কি না, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিতেন—না। শুধু আপা হাসতেন, কিন্তু আমরা জানতাম তিনি তা দুলাভাই পছন্দ করেন বলেই পরতেন। আমার বোন শিল্পী ছিলেন। তাই নিজের অনেক জামদানি শাড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা নিজেই করতেন। শাড়ির রং, পাড় কেমন হবে, তা তিনি পছন্দ করে দিতেন। এ জন্য পরিবারের কোনো বিয়েতে, ঈদে বা অন্য অনুষ্ঠানে আপাকে ছাড়া কারও চলত না। এসব ব্যাপারে তিনি মোটেও বিরক্ত হতেন না, বরং উৎসাহে সবার জন্য শাড়ি পছন্দ করে দিতেন। বিয়েতে বাড়ির মেয়ে-বউরা কী রং পরবেন, খালা, মা কী রং পরবেন এমনকি ছেলেরা কী রঙের পাঞ্জাবি পরবে, আপা সব ঠিক করে দিতেন।
আপা ও দুলাভাইয়ের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে ব্যাংককের ১০ বছর। সে সময় আমি কয়েকবার তাঁদের ওখানে বেড়াতে যাই। সেখানে তাঁরা বাঙালিদের নিয়ে ‘পূরবী’ নামে একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক সংঘ গড়ে তোলেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেখানে কোনো নামকরা শিল্পী না থাকলেও শুধু শৌখিন শিল্পীদের দিয়ে এত সুন্দর অনুষ্ঠান হতে পারে, তা আগে আমি দেখিনি। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য পর্যন্ত তাঁরা মঞ্চস্থ করেছিলেন। একবার একটি অনুষ্ঠানের আগে আমি ব্যাংককে যাই। আপা-দুলাভাই আমাকে বললেন কয়েকটি মেয়েকে একটি নাচ শিখিয়ে দিতে। আমি নাচ ছেড়েছি বহু আগে, তাই ইতস্তত করছিলাম। তবু তাঁদের না করতে পারলাম না। যা-ই হোক, ছয়জন মেয়ে মঞ্চে ‘সুন্দরী কমলা নাচেরে...’ গানের সঙ্গে নাচল এবং দর্শকদের অনেক প্রশংসা কুড়াল। সেদিন আপা, দুলাভাই আমাকে নিয়ে যে কত গর্বিত হয়েছিলেন, তা বলার নয়, আমিও সেদিন অত্যন্ত তৃপ্তিবোধ করেছিলাম।
আপার আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি নিজে হাতে রান্না করতে ভালোবাসতেন। দেশ-বিদেশের অনেক রকমের রান্না জানতেন। শত কাজের মাঝেও তিনি দুলাভাইয়ের জন্য একটি তরকারি অবশ্যই রান্না করতেন।
আমার স্বামী মইনুল হাসানের মৃত্যু হয় ১৯৯৯ সালে। এ সময় আমি খুবই একা ও অসহায় বোধ করতাম। আমার এ দুঃসময়ে আপা আমাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন, আমার মনোবল বাড়িয়েছেন। আপা প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসতেন, আমার সঙ্গে সময় কাটাতেন। ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস, মাত্র ছয় বছর পর আপাও দুলাভাইকে হারালেন। ওই সময় আপাকে ভেঙে পড়তে দেখেছি। সাথিহারা বেদনা যে কী, তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। প্রায় প্রতিদিন স্কুল শেষ করে দুপুরে আপার বাসায় চলে যেতাম। আমার জন্য তিনি অনেক সময় না খেয়ে বসে থাকতেন, আমি তা নিয়ে আপত্তি করলে তিনি বলতেন, ‘একা খেতে ইচ্ছা করে না, তাই তোর জন্য অপেক্ষা করি।’ আমাদের দুজনের এই চরম দুঃখের ভাগাভাগির সময় আমরা দুই বোন অত্যন্ত মনের কাছাকাছি চলে আসি। আমাদের এ বন্ধন ছিল একান্ত সহানুভূতির, ভরসার ও মমতার।
আমার স্কুলের সহকর্মীরা যাঁরাই তাঁকে দেখেছেন, তিনি তাঁদের আপন করে নিয়েছেন। আমার সহকর্মী শিবানী, লায়লা তাঁকে একসময় আমার মতো মেজ আপা বলে ডাকতে শুরু করেন। দুলাভাই শাহ এ এম এস কিবরিয়ার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের প্রত্যাশায় আপা শান্তিপূর্ণভাবে অনেকগুলো সমাবেশ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এর মধ্যে জনতার স্বাক্ষর নেওয়া, শান্তির সপক্ষে নীলিমা উল্লেখযোগ্য।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল—এই পাঁচ বছর আপাকে আমি খুব কাছাকাছি পেয়েছি। আমি ২০০৯ সালে আমার মেয়ের (তরী) কাছে বোস্টনে চলে আসি। আপাও তাঁর চিকিৎসার জন্য প্রতিবছরের গ্রীষ্মকালে তাঁর মেয়ের (নাজলী) কাছে বোস্টনে আসতেন। আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহ শেষে তাঁকে দেখে আসতাম। মাঝেমধ্যে তিনিও আমার কাছে আসতেন। এর মধ্যে একবার আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে প্রথমেই আপার চিন্তিত চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তোর কিছু হবে না। শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবি।’ আমি সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আপা দিনে দিনে আরও ভেঙে পড়লেন। আমি প্রায়ই রান্না করে তাঁর জন্য খাবার নিয়ে যেতাম, আপা এত অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও আমার প্রিয় খাবারটি রান্না করে রাখতেন।
ছোট ছেলেমেয়েদের আপা খুব ভালোবাসতেন। খেলার ছলে সুন্দরভাবে তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন। কখনো বই পড়তেন, কখনো রংতুলি দিয়ে তাদের সঙ্গে ছবি আঁকতেন। তরীর দুই মেয়েকে (আভা ও সাফিয়া) তিনি খুব স্নেহ করতেন। তারা বিরক্ত করবে বলে তাদের বাড়িতে রেখে আসতে চাইতাম, আপা খুব রাগ করতেন। বলতেন, ‘আভা না এলে আমার ভালো লাগে না।’
২০১৫ সালে আপা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে সময় নাজলীকে দেখেছি কীভাবে সে তার মায়ের দেখাশোনা করেছে। প্রতি সপ্তাহে সবকিছু ফেলে সে আপাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। চরম ধৈর্যের সঙ্গে সেখানে অপেক্ষা করেছে। মাঝেমধ্যে নাজলীকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য আমিও হাসপাতালে যেতাম। আপার সঙ্গে গল্প করতাম, সাহস দিতাম। তিনি আমাকে দুঃখ করে বলতেন, স্বামী হত্যার বিচার তিনি হয়তো দেখে যেতে পারবেন না, আর তাঁর বইটিও তিনি শেষ করে যেতে পারবেন না। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিতাম, বলতাম, নিশ্চয়ই পারবেন। হাসপাতালে তিনি সব সময় আমাকে কাছে এসে বসতে বলতেন। আপা আমার হাতখানা ধরে থাকতেন।
আমি আজও আমার স্নেহময়ী বোনের হাতের স্পর্শ অনুভব করি।
লেখক: সাবেক সিনিয়র শিক্ষক, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা