রয়নার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা টিকল না। কবিতা আমাদের কাছাকাছি এনেছিল—দুজনকেই। জানতি হয়তো, লেখালেখি সূত্রেই আমাদের পরিচয়। আমি আবুল হাসান পছন্দ করতাম, সে জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু দাশবাবু ও হাসান আমাদের নিকটবর্তী করলেও বালু দিয়ে গড়া দুজনের সম্পর্কের মধ্যে ইটের ভিত্তি দিতে পারেননি।
কারণটা কী জানিস, শুধু ‘সরি’—এই একটি শব্দ না বলা। আমাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে ছোট্ট শব্দ—সরি। ভাবছিস, এটা আবার কেমন কথা!
কিন্তু এটাই সত্য, সত্যের চেয়েও বেশি নির্জলা সত্য।
রিলেশনের তিন বছরের ভেতরে রয়নার কাছে আমি কখনো সরি হইনি। ওকে সময় দিয়ে বরাবরই আমি দেরি করে আসতাম, আসতে পারতাম না সময়মতো। আমার জন্য সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। কিন্তু এই দেরির জন্য তার কাছে যে দুঃখ প্রকাশ করা প্রয়োজন, সরি হওয়া দরকার—এটা আমার মনে এলেও মুখ ফুটে বলা হয়নি কখনো। এখন বুঝতে পারি, আমার ভেতরকার অহংবোধই আমাকে এটা করতে দেয়নি।
দিনের পর দিন সরি না হতে হতে শেওলা জমে গেল সম্পর্কে। পরে তো সুতোটি ছিঁড়েই গেল। একটুর জন্যই অনেক কিছু হলো না আমাদের। কবীর সুমনের সেই গানটা মনে আছে? ‘একটুর জন্য কত কিছু হয়নি...একটুর জন্য, প্রেম দিল চম্পট, তবুও হৃদয় করে আশা নিয়ে ছটফট।’ এতটুকু সরি যদি সেদিন বলতাম...
ভাবছিস এত দিন পরে তোকে এসব কথা বলছি কেন? মনটা ভালো নেই দোস্ত। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া রাতে আজ রয়নাকে খুব মনে পড়ছে। বিয়ে করে রয়না এখন মন্ট্রিয়লে—সবই জানি। তবু তাকে কেন মনে পড়ে?
দুদিন আগে বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে আমার ফেসবুক মেসেঞ্জার হঠাৎই শব্দ করে জেগে উঠল, ইনবক্স ফুঁড়ে ভেসে উঠল স্বপনের এই আবেগপ্রবণ লেখা। স্বপন আমার বন্ধু। একই ক্যাম্পাসে আমরা কাটিয়েছি বিস্তর সময়। রয়নার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল—এ আমরা বিলক্ষণ জানতাম। কিন্তু সেই সম্পর্ক কেন ‘নাই’ হয়ে গেল, এতকাল তা ছিল অজানা। এই চন্দ্রধোয়া রাতে প্রাক্তনের জন্য স্বপনের আবেগ উথলে উঠেছে—এটা বেশ বুঝতে পারছি। এমন সময় মেসেজের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবি লোকগানের একটি লিঙ্কও পাঠাল স্বপন, ‘চান কিথা গুজারি আয়ি রাত ভে/ ম্যান্ডা জি দলিলাঁ দে বাত ভে’ (ও আমার চাঁদ, গত নিশি কোথায় কাটালে/ আমার মন শুধু এ কথাই ভেবে মরে)। সুরিন্দর কৌরের এ গানের সুরের হাহাকারের সঙ্গে স্বপনের মেসেজের হাহাকার মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল। গানটি আমার হৃদয়েও দোলা দিল। মনে হলো, আহা একটু সরির জন্য...একটু সরির জন্য স্বপনের জীবনটা কি ‘পুরো সরি’ হয়ে গেল? রয়নার জীবনও কি তা–ই?
স্বপন আর রয়নার ঘটনাগুলো সত্যি হলেও তাঁদের আসল নাম এখানে বদলে দেওয়া হয়েছে। আদতে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের টুকরো টুকরো গল্প যেখানে সত্যি, সেখানে নামে কীই–বা আসে–যায়! সব মানুষের ভেতরেই হয়তো ‘কমন’ কিছু গল্প আছে। স্বপন ও রয়নার গল্পটিও তেমন।
আমাদের নাগরিক জীবনে পরস্পরকে সরি বলার অভ্যাস খুব একটা নেই। যে কারণে স্বপন–রয়নার মতো প্রেমিক–প্রেমিকা, যেকোনো দাম্পত্য সম্পর্ক বা বাবা–মা, ভাই–বোন অথবা বন্ধুত্ব—সব ক্ষেত্রেই সম্পর্কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কথা আজকাল হরহামেশায় বলছেন মনোবিদেরা।
অনেকে ভাবতে পারেন, কোনো ভুলের জন্য একে অপরকে দুঃখ প্রকাশ করা মানে সরি বলা—এ আর এমন কী, একটা আচরণ বা কেতামাত্র, প্রতিদিনের জীবন–অভ্যাসের মধ্যে এটা না করলে কী হয়? কিছুই হয় না, সবার অগোচরে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ইট–সুরকি ক্ষয়ে যায় কেবল, তারপর একসময় তা ভেঙেও পড়তে পারে।
এমন ভাঙনের নমুনা আমাদের চারপাশে এখন কম নয়। ‘নিঃসঙ্গতা’ কবিতায় একদা আবুল হাসান লিখেছিলেন, ‘অতটুকু চায়নি বালিকা!/ অত শোভা, অত স্বাধীনতা!/ চেয়েছিল আরও কিছু কম।’ এই ‘কম কিছু’ চাওয়া—অধুনাকালের বাস্তবতায় সেটা হয়তো ‘সরি’ শব্দটিও হতে পারে। এমন কথাই শোনা গেল মনোবিদ আহমেদ হেলালের কথায়। একে অপরকে আমরা যে সরি বলতে পারি না, এর পেছনে মোটা দাগে তিনি দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, ‘শৈশব থেকে ধারণার ভিত্তিতে আমরা যে আচরণ করি, মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট’ বলা হয়, তার মধ্যে ত্রুটির কারণে পরস্পরকে অনায়াসে আমরা সরি বলতে চাই না। সহজ ভাষায় বললে, আমাদের চারপাশে যে আচরণগুলোর চর্চা হয়ে থাকে, তার মধ্যে সরি বলা বা দুঃখ প্রকাশের প্রবণতা কম। সরি বলাকে লোকজন নিজের পরাজয় বলে মনে করে। ফলে সামান্য দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমেই যা মিটে যেতে পারত, সরি না বলার কারণে দিনে দিনে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।’
আর দ্বিতীয় কারণটিকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘ইগো ডিফেন্স মেকানিজম’। তাঁর মতে, আমাদের মনের অভ্যন্তরে ইড, ইগো ও সুপার ইগো নামের তিনটি স্তর রয়েছে। ইড হলো নেতিবাচক প্রবৃত্তি এবং সুপার ইগো মানুষের মহৎ প্রবৃত্তি। আর এই দুই প্রবৃত্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ইগো বা অহং। যখন এই ভারসাম্যের ঘাটতি হয় তখন এমনটা ঘটতে পারে। দুই কারণের কথা বলার পর কথার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নোক্তাও দিয়েছেন আহমেদ হেলাল, ‘আমাদের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও গণমাধ্যমে সরি বলার চর্চাটা সেভাবে নেই। তাই আমাদের মধ্যেও অভ্যাসটা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া পরিবারসহ গণমাধ্যমে সরি বলাকে নেতিবাচক হিসেবে চিত্রিত করার কারণেও আমরা এটা বলতে অনাগ্রহ বোধ করি।’
যেকোনো ধরনের সম্পর্কের পরিচর্যায় সরি যে টনিকের মতো, এতক্ষণ পর তা আর না বললেও চলে। কিন্তু কীভাবে গড়ে তোলা যাবে এই অভ্যাস?
এ ক্ষেত্রে আহমেদ হেলালের পরামর্শ হলো, ‘প্রথমত, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দুঃখ প্রকাশ করার মধ্যে যে পরাজয় বা লজ্জার কিছু নেই—এটা বুঝতে হবে সবার আগে। এর শুরুটা পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হতে পারে। আর গণমাধ্যমেরও এতে বড় ভূমিকা আছে। মানুষ যেহেতু দেখে শেখে, তাই গণমাধ্যমে ইতিবাচক অর্থে সরি বলার চল বাড়াতে হবে।’
মনোবিদের কথা শুনতে শুনতে আমার বন্ধু স্বপন এবং তার প্রেমিকা রয়নার কথা ভাবি। স্বপন সেদিন যদি রয়নাকে সরি বলত, তাহলে কি রয়না থাকত ওর সঙ্গে? অন্তত স্বপনের মেসেঞ্জার–ভাষ্য তো তা–ই বলে। িকংবা অন্য কোনো রয়না যদি অন্য কোনো স্বপনকে বলত সরি। তখন কি মাঝরাতে চরাচরপ্লাবিত জ্যোৎস্নার মধ্যে প্রস্ফুটিত চাঁদের দিকে তাকিয়ে অবোধ্য আবেগে দিওয়ানা হয়ে স্বপন বলত:
‘ও আমার চাঁদ, গত নিশি কোথায় কাটালে
আমার মন শুধু এ কথাই ভেবে মরে।’
কে জানে!\