
গত ২৮ মার্চ। সকাল প্রায় ১০টা। পৌঁছালাম চট্টগ্রামের পটিয়া পৌর সদরের মোহছেনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একটি ক্লাস থেকে হারমোনিয়ামে গানের সুর ভেসে আসছে। এগোতেই দেখলাম গানের ক্লাস নিচ্ছেন একজন। তিনি উম্মে তানজিলা চৌধুরী। দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
গানের ক্লাসের ফাঁকে কথায় কথায় জানা গেল তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি। মোহছেনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উম্মে তানজিলা প্রথম আলোকে জানান, এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচির লিডারশিপ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
তানজিলারা চার বোন ও এক ভাই। উম্মে হাবিবা চৌধুরী, উম্মে সালিমা চৌধুরী, উম্মে তাসলিমা চৌধুরী ও উম্মে তানজিলা চৌধুরী—চার বোনই দৃষ্টিহীন। চট্টগ্রামের পটিয়ার কাচুয়াই ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামে তাঁদের বাড়ি। চোখের আলো না থাকলেও শিক্ষার আলো দিয়ে তাঁরা এগিয়ে চলছেন।
চার বোনের তিনজনই এখন শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর (এলএলএম) ডিগ্রি নিয়ে উম্মে হাবিবা চৌধুরী চট্টগ্রামের পটিয়া পৌর সদরের শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। উম্মে তাসলিমা চৌধুরী রাজনীতিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর, দক্ষিণ গৌবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। উম্মে তানজিলা চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। উম্মে সালিমা চৌধুরী চলতি বছর সমাজতেত্ত্ব স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন।
উম্মে তাসলিমা চৌধুরী জানান, তাঁদের বড় করার জন্য ছোটবেলায় তাঁদের বাবা পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি জমান। সেখানে মুরাদপুর সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের পড়াশোনায় হাতেখড়ি। ওই বিদ্যালয়ের হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করেছেন।
প্রাথমিকের পর মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তি হতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এই চার বোনকে। বিশেষ করে বড় বোন হাবিবাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ব্রেইল পদ্ধতি না থাকায় ভর্তি করাতে আগ্রহী ছিলেন না শিক্ষকেরা। তবে সহযোগিতা করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে বই তৈরি করে দিতেন।
কীভাবে পড়াশোনা করতেন
ক্লাসে স্যারদের লেকচার শুনে তাঁরা রেকর্ড করে নিতেন। কলেজে লেকচার শিটগুলো শিক্ষকেরা ফটোকপি করে দিতেন। তা বন্ধুদের সহযোগিতায় ব্রেইলে রূপান্তর করে নিতেন। তাসলিমা প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সমাজতত্ত্ব বিভাগের ডিন গাজী সালাউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আকতার, সহযোগী অধ্যাপক এ বি এম নিয়াজ উদ্দিন স্যারের সহযোগিতা না পেলে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ হতো না।
পটিয়ার সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়গুলোয় পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিনই এই তিন বোন সকাল নয়টার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। কাজের প্রতি খুব আন্তরিক তাঁরা—এমনটাও জানা গেল তিন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে।
এই চার বোন তাঁদের মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কারণ, তাঁরা কখনো তাঁদের বোঝা মনে করেননি। এখন সহকর্মীরাও অনেক সহযোগিতা করছেন।