আসাদ কারিগর

আসাদুজ্জামান খান
আসাদুজ্জামান খান

নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ৬৯তম জন্মবাষির্কীতে নিজের ৬৯টি শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী করছেন আসাদুজ্জামান খান। এগুলো তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছেন গাছের গোড়া ও শিকড়। এই ভাস্কর আসাদের গল্প ধরেই হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন নাটক জহির কারিগর

নুহাশপল্লীর বৃষ্টি বিলাসের বারান্দায় আসাদের শিল্পকর্ম। ছবি: ছুটির দিনে

জহির গ্রামের সরল প্রকৃতির একজন মানুষ। একার সংসার। দিনমান গাছের শিকড়-বাকড় নিয়ে পড়ে থাকেন। এসব দিয়েই বানিয়ে ফেলেন বিভিন্ন পশু-পাখি। একদিন গ্রামের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি কৌশলে জহিরকে ভিটেমাটিছাড়া করে। কিন্তু তাতেও এই কারিগর নির্বিকার। নিজের তৈরি শিল্পগুলো নিয়ে শালবনে ঠাঁই নেন।

এটি নাটকের গল্প। জহির কারিগর নামে নাটকের জহির এভাবেই এগোতে থাকে। এই নাটকের নির্মাতা কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নাটকে যেসব শিল্পকর্ম দেখানো হয়েছে তার সবই আসাদের তৈরি করা। তাহলে কি নাটকের জহির কারিগরের গল্পটিও আপনাকে নিয়ে? হাসলেন আসাদুজ্জামান খান। ‘না না, আমাকে নিয়ে নয়। তবে গ্রামের মানুষ জহির কারিগরকে যেভাবে টিটকারি দেয়, সেগুলো আমাকেও সহ্য করতে হয়েছে।’

গাছের শিকড় দিয়ে শিল্পকর্মের কারণে হুমায়ূন আহমেদের সান্নিধ্য পান ভাস্কর আসাদুজ্জামান খান। তাঁর শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়েছিলেন এই কথাসাহিত্যিক।

১৫ নভেম্বর কথা হচ্ছিল ভাস্কর আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে। ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের ৬৯তম জন্মবাষির্কী উপলক্ষে তিনি এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামে নুহাশপল্লীর বৃষ্টি বিলাসের বারান্দায় তাঁর প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে ৬৯টি শিল্পকর্ম। সংখ্যাটাই জানান দেয়, প্রিয় লেখকের জন্মদিন স্মরণেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন। তাঁর শিকড় শিল্পকর্মের রয়েছে রাজহাঁস, কচ্ছপ, নাগ-নাগিণী, পেঙ্গুইনের ছানা, তিমিসহ বিভিন্ন প্রাণী। আসাদুজ্জামান বললেন, ‘ভেবেছিলাম এক সপ্তাহ প্রদর্শনী চালাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। চলতি মাসজুড়েই চলবে এই প্রদর্শনী।’

গাজীপুরের পিরুজালী ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে আসাদুজ্জামান খানের বাড়ি। শাহেদ আলী ও হামিদা খাতুন দম্পতির ছয় ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আসাদ। ৪২ বছর বয়সী আসাদুজ্জামান খান ১৯৯৩ সালে শ্রীপুরের বারতোপা এ কে এম হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকার মোহাম্মদপুরের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালে ডিপ্লোমা ইন প্রিন্টিং টেকনোলজি পাস করেন। প্রথমে প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা শুরু করলেও তা বেশি দিন টেকেনি। গ্রামে ফিরে গাছের শিকড়-বাকড় দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন।

হুমায়ূন-সান্নিধ্য

ভাস্কর আসাদ বলেন, ‘আমার বানানো ভাস্কর্য দেখে এলাকার মানুষজন নানা ধরনের মন্তব্য করত। অনেকে খেপিয়ে তুলত।’ কিন্তু হাল ছাড়েননি আসাদ, ‘আমার মনে হলো শিল্পকর্মগুলো তেমন কাজে আসছে না। কেউ মূল্যায়নও করছে না।’

তখন হুমায়ূন আহমেদ তাঁদের পিরুজালী গ্রামে প্রায়ই যেতেন। নাটকের শুটিং করতেন। ২০০৭ সালের ঘটনা। তিনি নুহাশপল্লী গিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে গাছের শিকড়-বাকড়ের তৈরি কয়েকটি শিল্পকর্ম উপহার দেন। ব্যতিক্রমী জিনিসপত্র উপহার পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

এরপরই হুমায়ূন আহমেদের সান্নিধ্যে চলে আসেন আসাদ। আসাদ বলেন, ‘হুমায়ূন স্যার একদিন বললেন, ‘‘গেটের পাশে মা ও শিশুর একটি ভাস্কর্য তৈরি করব। তুমি মাটি দিয়ে হোক অথবা কাগজ দিয়ে হোক একটা ডিজাইন করে আমাকে দেখাও।’’ নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একসময় ভাস্কর্যটি তৈরি করি।’ তারপর? আসাদ বলেন, ‘স্যার বিদেশ থেকে এসে ভাস্কর্য দেখে বললেন, বাহ্ সুন্দর হয়েছে।’

নিজের সৃষ্টি িনয়ে আসাদ

তাঁর বেশ কয়েকটি কাজ দেখে হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দেন। আসাদ কোনো কিছু চিন্তা না করেই হুমায়ূন আহমেদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এরপর তিনি তৈরি করেন দৃষ্টিনন্দন মৎস্যকন্যা, সুইমিংপুলের এক পাশে মানুষের মাথার কঙ্কাল, ব্যাঙের ছাতা, সংস্কার করেন দৈত্যের বুকসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম। তাঁর শিল্পকর্মগুলো হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, গ্রামবাংলার কৃষক, মা ও ছেলে, প্রেমিক যুগল, রাজহংস, ঘুঘু, ময়ূর, পেঙ্গুইন, দোয়েল, সাপের ভালোবাসা, বক আরও অনেক কিছু। তাঁর শিল্পকর্মগুলোর সবই তৈরি করা হয়েছে গাছের শিকড় ও পরিত্যক্ত গাছের গোড়া সংগ্রহ করে।

আসাদুজ্জামান সম্পর্কে নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আসাদ একজন প্রতিভাবান ছেলে। সে সব সময় শিল্প নিয়েই পড়ে থাকে। নুহাশপল্লীর সব কর্মীর মতো আসাদও হুমায়ূন স্যারের খুব কাছের ছিল।’

ভাস্কর আসাদুজ্জামান খান আগামী বছরে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন। সেদিন কথায় কথায় আসাদ জানালেন, নুহাশপল্লীতে ৭০টি কবুতর পোষা হচ্ছে। আগামী বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে উড়িয়ে দেওয়া হবে কবুতরগুলো।