অনেকে পেশাজীবন শুরু করেছেন আবার অনেকে পেশাজীবন শুরু করার পর বেশ সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু হয়তো পুরোপুরি জানা নেই পেশাক্ষেত্রের আদবকেতা সম্পর্কে। পেশাজীবনে সফল হতে গেলে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। কেবল কাজে দক্ষ হলেই পেশায় সফল হওয়া যায় না। বিশেষভাবে নজর দিতে হয় কর্মক্ষেত্রের নানা ধরনের আদবকেতার দিকে। সমান গুরুত্ব দিতে হবে পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে। কর্মক্ষেত্রের আদবকেতা নিয়ে কথা বলেছেন পেশা বিশেষজ্ঞরা। এ প্রতিবেদনে সেসবই তুলে ধরা হয়েছে।নজর দিন পোশাক-আশাকেকর্মক্ষেত্রে পোশাক-আশাক একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। পোশাকের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে থাকেন। করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ যিশু তরফদারের মতে, ‘পেশার ক্ষেত্রে পোশাকের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে একজন কর্মীর পেশাদারি আচরণ। সাধারণত পোশাক-পরিচ্ছদ নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের ধরনের ওপর। অনেক প্রতিষ্ঠানের একটা সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি রয়েছে। সেই অনুপাতে কর্মীদের পোশাকের ধরনটিও হবে প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই।’ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক-বিমা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের বিধিবদ্ধ, মার্জিত অর্থাৎ ফরমাল পোশাক পরে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট ও পরিষ্কার জুতা পরে আসতে হবে। প্রতিদিন ক্লিন সেভ করা ভালো। চুল যেন বেশি বড় না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি জুলফি বড় না রাখাই ভালো। মেয়েরা শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরতে পারেন। পশ্চিমা পোশাক হলে তা ফরমাল হওয়াই ভালো। প্রতিষ্ঠানে প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট মাপ বজায় রাখতে হবে। এর সঙ্গে গয়না ব্যবহারও যেন অতিরঞ্জিত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতির সঙ্গে পোশাক-পরিচ্ছদ যেন উপযুক্ত হয়। কোনোভাবেই এর মাধ্যমে যেন উগ্রতা প্রকাশ না পায়। এ জন্য চড়া রং পরিহার করতে হবে। হালকা রঙের পোশাক পরা যেতে পারে। আর পোশাক-পরিচ্ছদ যাতে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। হালকা সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারেন। কোনোভাবে তা যেন বেশি কড়া না হয় সেদিকে নজর দিন। সব পেশার ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী পোশাক পরিধান করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অনেক সৃজনশীল পেশাক্ষেত্র যেমন বিজ্ঞাপনী সংস্থা, গণমাধ্যম ইত্যাদির ক্ষেত্রে পোশাক-আশাকে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। যাহোক, পেশার ক্ষেত্রে অবশ্যই সংযত পোশাক-পরিচ্ছদ পরে আসতে হবে। যিশু তরফদার বলেন, পোশাকের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। তাই পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানের ক্ষেত্রে নানা আদবকেতা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়।প্রকাশ করুন নিজেকেপেশাজীবন শুরু করার পর থেকেই নিজেকে অন্যের সামনে প্রকাশ করতে হবে। সকালবেলা কর্মক্ষেত্রে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে মিষ্টি হেসে শুভেচ্ছাবিনিময় করতে পারেন। ফলে আপনার সম্পর্কে সবার মধ্যে একটা ভালো ধারণা তৈরি হবে। গম্ভীর থাকলে সহকর্মীরা আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে পারেন। সহকর্মী কারও জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা বিশেষ দিনে শুভেচ্ছাবিনিময় করুন। এতে আপনার সম্পর্কে অন্যের একটা ভালো ধারণা তৈরি হবে। পেশাবিষয়ক বই লেখক এবংমোবাইল ফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান রবির মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক রাজীব আহমেদ জানান, বিভিন্ন কাজে সাধ্যমতো অন্য সহকর্মীদের সাহায্য করুন। দেখবেন, একটা সময় আপনার প্রয়োজনে বিভিন্ন কাজের সহযোগিতা করবেন সহকর্মীরাই। অন্যের সঙ্গে মেশার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এতে আপনার কর্মক্ষেত্রে কাজ সহজে হবে।আচার-আচরণ হবে মার্জিতপ্রতিষ্ঠানে একজন কর্মীর সব ধরনের আচরণে পেশাদারি ভাব প্রকাশ পাবে। তাঁর আচরণ হবে মার্জিত। ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা তাহিনয়্যাত এ করিম বলেন, ‘এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যায় না। এটি ঠিকমতো না হলে পেশাক্ষেত্রে কোনোভাবে সফল হওয়া যায় না।’ তিনি যোগ করেন, ‘কোনো একজন কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজে পারদর্শী কিন্তু আচার-আচরণ ভালো না, তিনি কোনো দিনই সফল পেশাজীবী হতে পারবেন না। পেশার ক্ষেত্রে ভালো আচরণের বিকল্প নেই।’কর্মক্ষেত্রে ছোট-বড় সবার সঙ্গে উপযুক্ত আচরণ করতে হবে। সহকর্মীদের সঙ্গে উঁচুগলায় বা চড়ামেজাজে কথা বলা উচিত নয়। এ ছাড়া আচরণের বিভিন্ন মুদ্রাদোষ পরিহার করে চলতে হবে। যেমন, উচ্চ স্বরে ফোনে কথা না বলা, জোরে না হাসা প্রভৃতি। যাঁরা গ্রাহকসেবার কাজ করবেন, তাঁদের ধৈর্য নিয়ে গ্রাহকের কথা শুনে সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে। কোনো বিরক্তি ভাব প্রকাশ করা যাবে না। সহকর্মীরা বিব্রত হবেন, এমন বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে। এ ছাড়া এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করে। এভাবে আচার-আচরণে আদবকেতা বজায় রাখতে হবে।পালন করুন নিজের দায়িত্বএকটি প্রতিষ্ঠান একজন কর্মীর কাছ থেকে সব সময় প্রত্যাশিত কাজ চায়। সে ক্ষেত্রে নিজের কাজ ও দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। অন্যের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরুদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হলে তা নিজের মধ্যে পুষে না রেখে উপযুক্ত কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে। কাজের মধ্যে গতি আনতে পারলে প্রতিষ্ঠানে আপনার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।চাই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ও যোগাযোগ-কৌশলকর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন আদবকেতা তৈরির জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ও যোগাযোগের কৌশল একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। যিশু তরফদার মনে করেন, এই দুটি বিষয়ের যৌথ সম্মেলনে একজন পেশাজীবী বিভিন্ন আচরণে দক্ষ হয়ে ওঠেন। একজন ব্যক্তিকে পেশার ক্ষেত্রে সফলতার জন্য যেমন আবেগের নিয়ন্ত্রণ ঘটাতে হবে, তেমনি অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার কৌশলও রপ্ত করতে হবে। পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এ দুটি কৌশল নানাভাবে একজন পেশাজীবীকে সহায়তা করে এবং অন্যদের মনে ঠাঁই করে নিতে পারেন তিনি।আদবকেতা পেশার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বিষয়। এখন এ সংক্রান্ত বইপত্র বাজারে পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে এখন এ বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য খুব সহজেই পাওয়া যায়। সেখান থেকেও আদবকেতা সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। মোদ্দা কথা, পেশাজীবনে সফল হতে গেলে একজন কর্মীকে অবশ্যই আদবকেতা জানতে হবে।লক্ষ রাখুনপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এসব হলো— কাজে ফাঁকি না দেওয়া। সততা নষ্ট না করা। প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ লঙ্ঘন না করা। সহকর্মীদের বিভ্রান্ত না করা। যৌন হয়রানি বা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে উত্ত্যক্ত না করা। টয়লেট ব্যবহারের পর পরিচ্ছন্ন রাখা। বিব্রতকর ও স্পর্শকাতর বিষয় যেমন ধর্ম, রাজনীতি নিয়ে কাউকে কটাক্ষ ও হেয় না করা। কারও অগোচরে অহেতুক সমালোচনা পরিহার করা। অফিসের ভেতরে ধূমপান না করা।