কলেজের প্রথম বর্ষ শিক্ষার্থীদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া; সেই সঙ্গে একটু একটু করে নিজের দায়িত্ব নিতে শেখা—এই দীক্ষা তো কলেজজীবনেই শুরু হয়। ২০২০ সালে যারা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে, কলেজে না গিয়েই কেটে যাচ্ছে তাদের কলেজজীবন। বদলে যাওয়া এই সময়ে কলেজজীবনের স্মৃতি স্মরণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী।
মো. সাদাত হোসেন, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
‘তোমাদের মধ্যে কারা স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিলে?’ কলেজের প্রথম দিন প্রশ্ন করেছিলেন সঞ্জিত কুমার গুহ স্যার। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, ১২৫ জনের ক্লাসে প্রায় ৩০টা হাত উঠল। বুঝতে পারছিলাম, নটর ডেম কলেজ কেন আলাদা। কেউ চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, কেউ নারায়ণগঞ্জ। সবগুলো মুখই অপরিচিত। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, এই মানুষগুলোর সঙ্গেই আগামী দুই বছরের একটা বড় সময় কাটবে।
আমি ঢাকার শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছি। বাসার জানালা দিয়ে তাকালেই স্কুল দেখা যেত। তাই ‘একা একা’ কোথাও যাওয়ার আনন্দটা কলেজে ওঠার আগে সেভাবে পাওয়া হয়নি। কলেজে ওঠার পর সকাল আটটার ক্লাস ধরতে এক রকম ভোরবেলা বন্ধুদের সঙ্গে বের হতাম, সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
নটর ডেম কলেজে ব্যবহারিক ক্লাসগুলোর ওপর বাড়তি জোর দেওয়া হতো। কখনো কখনো ক্লাস শেষ হতে বিকেল হয়ে যেত। তার ওপর এত ঘন ঘন ক্লাস টেস্ট, কুইজ...এসবের মধ্য দিয়েই বোধ হয় পরীক্ষা-ভীতি অনেকটা কেটে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এই প্রস্তুতি কাজে দিয়েছে।
প্রথম দিনের ক্লাসেই শুনেছিলাম, এই ক্লাস থেকে অধিকাংশের জায়গা হয় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তখনই হয়তো আত্মবিশ্বাসটা আরও বেড়েছিল।
বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর মাত্র দুই সপ্তাহ ক্লাস করতে পেরেছি। এরপরই তো করোনার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেল। এখন যারা কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ছে, সবার সঙ্গে বসে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা তাদের হয়নি। অনেক কিছু মিস করল এটা ঠিক। কিন্তু আমি বলব, এই সীমাবদ্ধতা তো ওর বয়সী সবারই।
কলেজজীবনটা মাত্র দুই বছরের। পড়ালেখার অংশটা বাদ দিলে এই দুই বছর কিছু ভালো স্মৃতি তৈরি করার সুযোগ। ওদের স্মৃতিতে হয়তো ‘কলেজজীবন’ সেভাবে থাকবে না, কিন্তু এই কঠিন সময় পেরোনোর অভিজ্ঞতা থাকবে। এটাই ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
ইসরাত সুলতানা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম বরিশাল বিভাগের অমৃত লাল দে কলেজে। স্কুলজীবন পেরিয়েছি ছোট্ট শহর ঝালকাঠিতে। কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথমবার জেলা শহর থেকে বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা ছিল রোমাঞ্চে ভরপুর। আমাদের কলেজের ক্যাম্পাসটি খুবই ছোট হলেও গোছানো মনে হয়েছিল। তারপরও আমি কলেজের প্রথম ক্লাসটি করতে পারিনি। কারণ, রুটিন অনুযায়ী রুম নম্বর খুঁজে পাইনি। আবার অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতেও এক রকম জড়তা কাজ করছিল। কোথায় ক্লাস করতে যাব, কখন ক্লাস শুরু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর খুঁজতে খুঁজতে পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ক্লাসে মনোযোগী হতে পারিনি। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে বেগ পেতে হয়েছিল বলা চলে।
আমার বাসা থেকে বাসে করে কলেজে যেতে হয়। অথচ নিজের শহরের বাইরে একা চলার অভ্যাস আমার ছিল না একদমই। প্রথম দিন আব্বুর হাত ধরে কলেজে গিয়েছি, কিন্তু তারপর আমাকে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে। একটা হোস্টেলে ভর্তি হলাম। মনে হয়েছিল এক দমবন্ধ পরিবেশে এসে পড়েছি। এই হোস্টেলে বরিশাল বিভাগ ও এর বাইরে থেকে অনেক মেয়েরাও এসেছে। আমার অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু হোস্টেল জীবনের প্রথম সন্ধ্যায়ই দৃশ্যপট বদলে গেল। তখন পরিচয় পর্ব শুরু হয়েছিল। আমিও একেকজনকে চেনা শুরু করেছি। মনে হতে লাগল, কলেজজীবনটা তো মন্দ না!
শুরুতে কিছুটা ধাক্কা খেলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম, মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাটা সত্যিই বেশ দরকারি!