
বলিউডের ‘কৃষ’ সিনেমার রোহান চরিত্রটি অনেকেই চিনে থাকবেন! নায়ক রোহান সিনেমাটির একটি দৃশ্যে পাহাড়ে বেড়াতে আসা নায়িকা প্রিয়াকে তাঁর প্রকৃতির বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। তাই রোহানের ঠোঁটে বিশেষ শিস ওঠামাত্র পুরো পাহাড় উপত্যকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নীড় থেকে আকাশে ডানা মেলে। অপূর্ব সে দৃশ্য! ডানে পাহাড়, বাঁ পাশে ঢালু পাদদেশের গা বেয়ে চলে গেছে ট্রেইল, বাঁ পাশে উপত্যকার মতো কিছুটা সমতল ভূমি। তারপর পূর্ব-পশ্চিমে চলে গেছে এক সারি পাহাড়। ঝোপঝাড়–লতাগুল্মে ঠাসা। কদাচিৎ একটি–দুটি বৃক্ষ বুক সটান করে দাঁড়িয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ট্রেইল ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ এ রকম একটি বৃক্ষ থেকে আকাশে ডানা মেলে একঝাঁক পাখি। জলপাই–সবুজ রঙের মালকোয়া পাখির ঝাঁকের ডানার শব্দে চারপাশের বাতাসে যেন ঢেউ তুলে গেল। আমার তখন ‘কৃষ’ সিনেমার সেই দৃশ্য মনে পড়ে গেল!
সাহিত্যিক কালাচাঁদ ভাদুড়ির ছদ্মনাম কালাপাহাড়; জেনেছিলাম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে। তারও আগে ‘কালাপাহাড়’ নামের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র বাগেরহাটের খানজাহান আলী মাজারের একজোড়া কুমির। যাদের নাম ধলাপাহাড় ও কালাপাহাড়। তবে এরপর যে কালাপাহাড়ের সঙ্গে পরিচয়, সে আসলেই এক পাহাড়! ত্রিপুরা সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত কালাপাহাড় সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ চূড়া। উচ্চতা ১ হাজার ৯৮ ফুট। এই পাহাড়ের বিশেষত্ব হলো, এর পাদদেশ সমুদ্রসমতলের প্রায় সমান। অর্থাৎ এর চূড়ায় পৌঁছাতে হলে উচ্চতার পুরোটাই ট্রেকিং করতে হবে। আমাদের এবারের অভিযান সেই কালাপাহাড় চূড়ার অভিমুখে।
পঞ্জিকার পাতা সবে ফাল্গুনের স্পর্শ পেলেও প্রকৃতিতে তখনো একচ্ছত্র হিম হিম শীতের দাপট। এ রকম এক ভোরে সিলেট শহরের চৌহাট্টা থেকে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। গন্তব্য মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার রবির বাজার। আটজনের দলের নেতৃত্বে সদা হাস্যোজ্জ্বল কৃষ্ণ। মৌলভীবাজার শহর থেকে হাদি যাবে আরেকটি দল নিয়ে। যেতে যেতে হাকালুকি হাওরের একাংশ, পথে পথে আনারসবাগান, চা ও রাবারবাগানের মুগ্ধকর দৃশ্যপট পেরিয়ে আমাদের বাহন যখন রবির বাজার পৌঁছাল, ততক্ষণে রোদ মোটামুটি চড়ে গেছে। আমরা নাশতার জন্য একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। ইতিমধ্যে অন্য দলটিও পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া আমার অন্যতম ভ্রমণসঙ্গী রেজা ভাই প্রায় ৮০ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে বিয়ানীবাজার থেকে এসে যোগ দিয়েছেন। নাশতা শেষে ১৫ জনের দলের সবাই আবার বাহনে চড়ে বসি। আপাত গন্তব্য আসগরাবাদ চা–বাগান।
বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গ্রামীণ পথ যদিও পাকা, তবে একসঙ্গে দুটি গাড়ি পার হওয়া মুশকিল বৈকি। মোটামুটি অফ রোড। তাই গন্তব্যস্থলে যেতে হলো কিছুটা খুঁজে খুঁজে। আসগরাবাদ চা–বাগানে পৌঁছে হালকা দম ফেলে শুরু হয় আমাদের ট্রেকিং। চা–বাগানের ভেতর এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া সংকীর্ণ মেঠো পথ। পাহাড় থেকে নেমে এসে একটা ঝিরি বাগানের মাঝবরাবর বাঁক খেয়ে বাঁয়ে চলে গেছে। পায়ে চলা পথ গেছে ডান পাশ ধরে। যেতে যেতে একসময় চা–বাগান শেষ হয়, পাহাড়ের গা ধরে ট্রেইল শুরু হয়। মালকোয়ার ঝাঁকের দেখা পাওয়ার খানিক আগে দলের একজন হঠাৎ অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, দেখো দেখো একটা বক! একঝটকায় চোখ ঘুরিয়ে দেখি, মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে একটা হাড়গিলা পাখি উড়ে যাচ্ছে। তখনই মনে হয়েছিল অভিযানটা সম্ভবত মনের মতো হবে। ট্রেইলটি নেমে গিয়ে থেমেছে একটা সাঁকোর শুরুতে। ছোটখাটো একটা নদীই বলা যায়। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। সাঁকো পারাপারের পর আবার দুই পাশে পাহাড় রেখে চলা পথ।
হলদেটে মাটির পথটি কোথাও টিলা বেয়ে ওপরে উঠেছে, কোথাও আবার নেমে গেছে কোনো সাঁকো বরাবর। সেই একই নদী আপস্ট্রিমে এপাহাড়–ওপাহাড়ের পাশ কেটে বয়ে নেমে গেছে। আর সেসব পাহাড়কে যুক্ত করেছে সাঁকো। চারটি সাঁকো পার হওয়ার পর আমরা চড়াই ধরে টিলার ওপরে উঠে এলাম। নিচে দুই পাশ থেকে ঝোপঝাড়ের দঙ্গলে চেপে ধরা নদীটি এখন চেনাই দায়। টিলাময় পথটি চলে গেছে বেগুনছড়া খাসিয়াপুঞ্জি অভিমুখে। টিলার ওপর যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার ডান পাশে চমৎকার এক ফুটবল মাঠ। তিন দিকে পাহাড়, পাহাড়ময় অরণ্যের ঠাসবুনট। তার মাঝবরাবর মুগ্ধ করা খেলার মাঠটি। মূলত সেটি পুঞ্জির খাসিয়াদের খেলার মাঠ। আহা! কী দারুণই না হতো, যদি ওখানে কিছুক্ষণ খেলতে পারতাম। মনোলোভা রঙিন মাটির ওপর বাঁশের ফালি বসানো পুঞ্জির টিলায় উঠে যাওয়া পথ।
বেগুনছড়া খাসিয়াপুঞ্জি আসলেই মুগ্ধ করার মতো। পুঞ্জিতে মাঝারি পাকা ঘর যেমন আছে, তেমনি দেখলাম পুরোটাই মাটি দিয়ে বানানো কুটির। পুঞ্জির অধিবাসীদের বেশ হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল ও মিশুক মনে হলো; যা সাধারণত অন্য জায়গায় এতটা দেখিনি। এই যেমন খাসিয়া তরুণ গোল্ডেন সাগ্রহে রেজা ভাই ও আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। ওদের ভাষার কয়েকটা শব্দও শেখাল। গত বছর ক্লাস নাইনে উঠে আর পড়াশোনা না চালিয়ে যাওয়া খাসিয়া কিশোরী আংকিতা হাসিমুখে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। মনে রাখার মতো বৈকি। উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত খাসিয়ারা মূলত সিনতেং গোত্রভুক্ত একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। মাতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় কৃষিই তাঁদের প্রধান পেশা। খাসিয়া পান ও সুপারির চাষ তাঁদের জীবনের অন্যতম অংশ।
পুঞ্জি পার হওয়ার পর আসল বুনো পথ আর চড়াই–উতরাইয়ের শুরু। সামনে পড়ে একটা ওয়াই জংশন। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। গাইড দিলু শেখ পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনিই উদ্ধার করলেন। আমরা ডানের ট্রেইল ধরে হাঁটতে থাকলাম। বাঁয়ের পথটি গিয়ে নেমে গেছে ঝিরি বরাবর। ট্রেইলের সর্বত্র পড়ে থাকা ঝরাপাতার পসরা। কালাপাহাড়ে তখন ঝরাপাতার দিন। পায়ের তলায় ধ্বনি উঠছে মর্মর। শুকনা ঝরাপাতার স্তূপের ভেতর থেকে প্রাণের চিহ্ন নিয়ে মাথা তুলেছে সাদা–হলুদ–নীল লতানো ফুল। একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা ক্রমে ওপরে উঠছি। ট্রেইলের এক জায়গায় হঠাৎ চোখে পড়ে হাতির বড় বড় শুকনা মল।
গাইড দিলু জানালেন, কালাপাহাড়ে প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে বন্য হাতির আগমন ঘটে। ট্রেইল ধরে যেতে যেতে আরও কয়েক জায়গায় হাতির মলের দেখা পেলাম। তবে সব কটিই পুরোনো ও শুকনা। গাইড ভালো করে অবলোকন করে জানালেন, সম্ভবত সপ্তাহখানেক আগে বুনো হাতির পাল এসেছিল। বর্ষা–শরতে পাহাড় তরতাজা তরুলতায় ভরপুর থাকে বলে খাবারের প্রাচুর্যের জন্য তখন বন্য হাতির আগমন বেশি ঘটে বলেও জানলাম। তবে শিরদাঁড়া বেয়ে রোমাঞ্চ ও ভয় মেশানো একটা স্রোত নেমে গেল, যখন শুনলাম আজও হয়তো হাতির বড় পালের দেখা এমনকি সামনেও পড়ে যেতে পারি! সামনে তারপর পড়ে বেশ খাড়া একটি চড়াই। বেশ বেগ পেতে হলো সেটিতে উঠতে গিয়ে। পা ফসকে গিয়েছিল ঝুরঝুরে মাটিতে। গাছের শিকড় ধরে শেষতক রক্ষে।
পাহাড়টির চূড়ায় ওঠার পর চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিল কালাপাহাড়ের কালচে বর্ণের চূড়া। গাইডের ভাষ্যে, কালাপাহাড় চূড়ার চড়াইটি সবচেয়ে কঠিন। তাই খানিক জিরিয়ে নিলাম। তারপর আবার হাঁটা। মূল চূড়ার পাদদেশে দেখলাম খাসিয়া বালকদের পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে। বাল্যবেলা থেকেই শুরু হয়েছে ওদের প্রকৃতির পাঠশালা। কালাপাহাড় চূড়া আরোহণের শুরু হয়েছে ঘন মুলি বাঁশের বনের ভেতর দিয়ে। বাঁশ কেটে এঁকেবেঁকে ট্রেইল উঠে গেছে। বেশ খাড়া সেই ট্রেইল। হাঁটুর ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে, বুকে বাড়ছে হৃৎকম্পন। নাকমুখ হয়ে বের হওয়া হাঁপানোর শব্দ চাপা থাকছে না। এত কিছুর ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখ এড়াল না। মুলি বাঁশের বন মাড়িয়ে অবয়ব পাওয়া একটা অসচরাচর পথ। যেটা ওপরে না গিয়ে নিচের খাদের দিকে নেমেছে। পথের ব্যাপ্তি ঠিক ততটাই, যতটা একটা হাতির শরীরের আকার! আসলেই তাই; বন্য হাতির পাল এই দিকে বাঁশবন মাড়িয়ে নেমেছিল। বাঁশবনের পর বড় বড় গাছের ফাঁকফোকর বেয়ে উঠেছে ট্রেইল। কঠিন সেই ট্রেইল বেয়ে শেষতক কালাপাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলাম।
দাঁড়ানোর শক্তিও যেন আর নেই। বড়সড় একটা গাছের ছায়ায় সবাই বসে পড়ি। কিছুক্ষণ জিরানো আর নাশতার পর চলে যাই চূড়ার মাঝবরাবর একটা জায়গায়, যেটা অনেকটা ভিউ পয়েন্টের মতো। অপূর্ব, মনোমুগ্ধকর সেই ভিউ পয়েন্টে যখন দাঁড়ালাম, অপরূপ সুন্দরের সঞ্জীবনী শক্তি যেন সব ক্লান্তি শুষে নিল। চূড়ার পূর্ব পাশের খাড়া ঢালের ওপর বাঁশের বন কিছুটা সাফ করার ফলে তৈরি হয়েছে চমৎকার ভিউ পয়েন্ট। সেখানে সামনে তাকালে মুগ্ধ করা সবুজের দৃশ্যপটে যেতে যেতে দৃষ্টির সীমা ঝাপসা হয়ে আসে। অনেক নিচে অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের সারি। এতটাই নিচে যে, নিচের সেই পাহাড়–উপত্যকাও ধোঁয়াশে লাগে চোখে।
বর্ষাকাল হলে নিশ্চিতভাবে তা আড়াল করে দিত মেঘদল। প্রথমবার অনুভব করলাম, আমরা ঠিক কতটা ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। দলের চঞ্চল সদস্য জুনেদ, ছবি তোলায় ওর হাত বেশ পটু। ক্যামেরার লেন্স চোখ রেখেই বলে গেল, কালাপাহাড়ের আরেক নাম হারারগঞ্জ পাহাড়। দেশের উত্তর–পূর্বে অবস্থিত পাহাড়টির বেশির ভাগই পড়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের উত্তর ত্রিপুরার অন্তর্গত। সীমান্তের ওপাশে পাহাড়টির নাম রঘুনন্দন পাহাড়। ত্রিপুরার বিখ্যাত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঊনকোটি এই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। বুঝলাম সাগ্রহ কেবল ক্যামেরার লেন্সেই সীমাবদ্ধ নেই! এক সময় গাইডের তাড়ায় সম্মোহন কাটল। ফিরতি পথ ধরতে হবে। না হলে পথে রাত নামবে।
পরিকল্পনা অনুসারে ফিরতি পথটি ভিন্ন আরেকটা ট্রেইল। ফেরার পথে আমরা নামব ঝিরি হয়ে নেমে যাওয়া ট্রেইল ধরে। ঘণ্টা দেড়েক বাঁশবনের ভেতর দিয়ে নামতে থাকলাম। তারপর সামনে পড়ে ঝিরি। ঝিরিই এখন পথ। স্বচ্ছ টলটলে পানির ওপর পড়ে আছে বড় বড় পাথরের বোল্ডার। ঝিরিতে পাথরের ফাঁক গলে হাঁটা মুশকিল বটে। গাইড চোরাবালির বিষয়েও সতর্ক করে দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই চলার গতি মন্থর হয়ে গেল। ওদিকে দিনের আলোও কমছে। পেটের ভেতরও ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। ব্যাকপ্যাকেও শুকনা খাবার, পানি অবশিষ্ট নেই। ঝিরির কাদামাটিতে হাতির চরার চিহ্ন, তাজা মল চোখে পড়ল। হাতের এক টুকরা বাঁশের লাটি এখানে দারুণ বন্ধুত্বের পরিচয় দিল। অতঃপর ঝিরি পেরিয়ে শেষ শক্তি নিংড়ে সামনের পাহাড়ের উতরাই বেয়ে ওঠার সময় মনকে প্রবোধ দিলাম, পাহাড়টি বেয়ে উঠলেই খাসিয়াপুঞ্জি।