সরস রচনা

কুল না ফুল?

আঁকা: সাদমান মুন্তাসির
আঁকা: সাদমান মুন্তাসির

শীতের দুপুরে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেছি এক জোড়া চটি কিনতে। অনেক দেখাদেখি করে একটা বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু আমার আধুনিকা কিশোরী মেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘লুক অ্যাট ইয়োর ফিট, মাম্মা, ইটস নট কুল!’ মেয়েকে গ্রাহ্য না করে জুতাটা কিনে বাইরে এসে মনে হলো, কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়, ঠান্ডায় এবং অযত্নে আমার চরণ যুগল প্রায় কাকের ঠ্যাঙে পরিণত হয়েছে! কথাটা মাথায় ঘুরছিল, হঠাৎ রাস্তার মোড়ে একটা ভারী চমকদার বিউটি পারলার চোখে পড়ল। ভাবলাম, বরং এখান থেকে খানিক পদমার্জনা করিয়ে পায়ের ভোল ফেরাই।
যেমন ভাবা, আমরা মা-মেয়ে ঢুকলাম ভেতরে। ঢুকতেই কাউন্টারের মেয়েটি কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আগে নাম-ঠিকানা-মোবাইল নম্বর লিখে নিল। প্রথম ধাক্কা সামলে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালাম। একটি মেয়ে বেশ যত্ন করে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে পদসেবা শুরু করল। গরম জলের ছ্যাঁকা, নরুনের খোঁচা আর খামচাখামচির মাঝখানে হঠাৎ দেখি এক অতি সুসজ্জিতা মহিলা ভারি আন্তরিকভাবে আলাপ করতে এলেন। মহিলার চাকচিক্যে আমি তো মোহিত। জানতে পারলাম, ইনিই পারলারের মালকিন।
‘তা ভাই, আপনি ফেসিয়াল কোত্থেকে করান? আপনার স্কিন কিন্তু খুব ভালো!’ তাঁর প্রশংসাবাক্য আমাকে শাড়ির দোকানের কর্মচারীদের কথা মনে করিয়ে দিল। পৃথিবীতে একমাত্র তারাই আমাকে ‘ফরসা’ বলেন শাড়ি গছানোর জন্য। ভদ্রমহিলার প্রশ্নের জবাবে বললাম, ‘করি না তাই ভালো আছে।’ কথাটা কেমন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল!

তবে মহিলা সেটা শুনেও শুনলেন না, ‘সেকি, ফেসিয়াল করেন না? তবে আজই শুরু করুন।’

: কিন্তু আপনি তো বললেন, আমার স্কিন ভালো!

: আহ্হা, এখন ভালো আছে, কিন্তু আচমকা একদিন সকালে উঠে দেখবেন, চামড়া একেবারে কুঁচকে গেছে! আর ফেসিয়াল করলে বহুদিন আপনি একই রকম সুন্দরী থাকবেন।

আবার শাড়ির দোকানের কথাটা মনে হলো। যা হোক, বুড়ো হতে আমার তেমন আপত্তি নেই; আর তা ছাড়া আপত্তি করলেই কি আর বুড়ো হওয়া ঠেকানো যাবে? কিন্তু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আয়নায় নিজের কোঁচকানো মুখ দেখতে ভালো লাগবে কি না, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা আপনাদের চার্জ-টার্জ কেমন?’

: দেখুন, ফেসিয়াল অনেক রকম, তবে আপনার জন্য গোল্ডটাই সবচেয়ে ভালো হবে।

‘গোল্ড! মানে সোনা?’ আমি তো হকচকিত।

: হ্যাঁ, একেবারে ২৪ ক্যারেট।

‘না না, সেকি! সোনার তো আজকাল এমন দাম যে নাম মুখে আনতেও ভয় লাগে। গেল বছর মামাতো ভাইয়ের বিয়েতেই সোনা দিতে পারিনি আর শেষে কিনা মুখে মেখে নষ্ট করব!’ আঁতকে উঠে বলি।

: তাহলে এক কাজ করুন, আপনি বরং পার্ল ফেসিয়াল করুন, আপনাকে খুব স্যুট করবে।

: পার্ল মানে আপনি মুক্তোর কথা বলছেন? সেটাও নিশ্চয়ই আসল?

প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা মিষ্টি করে হেসে সায় দিলেন।

: দেখুন, এক-আধ ছড়া মুক্তোর হার আমার আছে বটে। কিন্তু সে তো সবই কালচার্ড। আসল মুক্তো তো কেবল মিউজিয়ামেই দেখেছি। এতটা বাড়াবাড়ি করা বোধ হয় ঠিক হবে না।

: বেশ, আপনি নাহয় ফ্রুট ফেসিয়ালই করুন, সেই–বা মন্দ কী!

মহিলাকে যত দেখছি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা যেন আমার বেড়ে উঠতে লাগল।

‘তা ফ্রুট ফেসিয়ালের ব্যাপারটা কী?’ আমি বেশ কৌতূহল বোধ করলাম। ছেলে ভোলানো মায়ের স্নেহে ভদ্রমহিলা বোঝাতে লাগলেন, ‘দেখুন, আঙুর, পেঁপে, বেদানা—সব ভালো ভালো ফল দিয়েই আমাদের ফ্রুট ফেসিয়াল। স্কিনের পক্ষে খুব ভালো।

: সেকি, ফলের যা দাম! তা এগুলো মুখে মেখে নষ্ট না করে খেলে ভালো হয় না?

এতক্ষণে ভদ্রমহিলার মাখন-গালে একটু বিরক্তির ভাঁজ পড়ল, ‘তা আপনার যা বাজেট মনে হচ্ছে, তাতে আপনি হারবাল ফেসিয়ালই করুন।’

‘সেটা কী রকম?’ আমি এখনো কৌতূহলী।

: এ হলো গিয়ে শাকসবজি, লতাপাতার ব্যাপার।

: যাক তাহলে, এটাই আমার পক্ষে ভালো। আজই বাসায় গিয়ে রান্নাঘরের জিনিস-টিনিস দিয়ে ব্যাপারটা সেরে ফেলব নাহয়।

কথাগুলো বলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তাড়াতাড়ি পদসেবার বিল মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বিউটি পারলার থেকে। ভদ্রমহিলাও যেন আমাকে বিড়াল-পার করে বাঁচলেন। মেয়ের মুখ দেখে অনুমান করলাম, সে একটুও খুশি নয় আমার ব্যবহারে। বুঝলাম, ফুল (অর্থাৎ বোকা) হতে চাইনি বলে কুল (অর্থাৎ আধুনিক) হওয়া আমার হলো না!