Thank you for trying Sticky AMP!!

গার্মেন্টস খাতে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে যে ১০ প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা উচিত

বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তৈরি পোশাকশিল্প খাতের বিপুল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে অনেকেই তাই এই খাতে পেশা গড়তে চান। সে জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন, কোন বিষয়ে পড়বেন, কী কী ধরনের সুযোগ আছে, এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে আমরা হাজির হয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও পেশাজীবীদের কাছে। জেনে নিন তৈরি পোশাকশিল্প খাতে পেশা গড়া নিয়ে প্রয়োজনীয় ১০ প্রশ্নের উত্তর।

গার্মেন্টস খাতে ভালো বেতনের চাকরি পেতে আপনি প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। ছবিটি ঢাকার একটি বায়িং হাউস থেকে তুলেছেন জাহিদুল করিম।

১. তৈরি পোশাকশিল্পে পেশা গড়তে চাইলে কোন বিষয়ে পড়া উচিত?

তৈরি পোশাকশিল্পে নানা রকম দক্ষতাসম্পন্ন মানুষেরা কাজ করেন। এখানে যেমন প্রকৌশলীদের প্রয়োজন হয়, তেমনি একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকও খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল প্রকৌশল, ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বিজনেস স্টাডিজের মতো বিষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা এই খাতে কাজ করছেন; অন্যদিকে তেমনি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) কিংবা শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়েও অনেকে গার্মেন্টস খাতে অবদান রাখছেন। অতএব প্রকৌশল থেকে শুরু করে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নানা বিষয়ে পড়ে আপনি এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির সহ–উপাচার্য অধ্যাপক আইয়ুব নবী খান বলেন, ‘এই খাতে উন্নয়ন চোখে পড়ার মত। শিল্পের পরিধি বাড়ছে, দেশে অনেক কাজের সুযোগ আছে। যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের নতুন প্রযুক্তি সম্পর্ক জানতে হবে। নিজস্ব জনবল দিয়েই আমাদের আরও ভালো করার সম্ভাবনা আছে।’ দেশীয় গবেষকদেরও কাজের সুযোগ আছে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

২. বাংলাদেশে এই খাতে ক্যারিয়ারের সুযোগ কেমন?

৪ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবর বলছে, বাংলাদেশ ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২–এর মার্চ সময়ের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে পণ্য রপ্তানি করে ৩ হাজার ১৪২ কোটি ডলার আয় করেছে। দেশে কয়েক হাজার তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তরুণদের। উর্মি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতে আমাদের লক্ষ্য হলো, ২০৪১ সালে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নানা চ্যালেঞ্জ আমাদের জয় করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই খাতে কাজের সুযোগ নিতে হবে। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিন্তু ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। সারা বিশ্বেই মার্চেন্ডাইজিং, সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বাড়ছে।’

৩. কী কী ধরনের কাজ করা যায়?

তৈরি পোশাক একটি দ্রুত বর্ধনশীল খাত। এ খাতে নানা ধরনের কাজের সুযোগ বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘৪০ লাখ শ্রমজীবী এই খাতে কাজ করছেন। তাঁদের ব্যবস্থাপনা, নতুন পণ্য উদ্ভাবন, সাপ্লাই চেইন, আইনগত বিভিন্ন বিষয়, নতুন খাত তৈরিসহ প্রকৌশল, মার্চেন্ডাইজিং, কমপ্লায়েন্সের মতো কাজের বহু জায়গা আছে। আমাদের তৈরি পোশাক খাত ধীরে ধীরে কাঠামোবদ্ধভাবে বিকশিত হচ্ছে বলে এখনকার শিক্ষার্থীরা সামনে আরও অনেক রকম কাজের সুযোগ পাবেন।’

৪. ছাত্রজীবনে ইন্টার্নশিপ বা অন্য কোনো উপায়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ আছে?

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তৈরি পোশাক খাতে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই কাজের সুযোগ আছে। বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউএফটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের বিভিন্ন গার্মেন্টসে ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এখানে নানা বিভাগে কাজ শেখার সুযোগ আছে। দেশি-বিদেশি ব্যবস্থাপক, নির্বাহী ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে হাতে-কলমে ছাত্রছাত্রীরা কাজ করতে পারেন। যাঁরা টেক্সটাইল বা ফ্যাশনের বাইরে অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়ছেন, তাঁরাও চেষ্টা করতে পারেন। একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা বিভাগ কাজ করে থাকে। অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, ম্যানেজমেন্টসহ অনেক জায়গাতেই তরুণেরা ইন্টার্নশিপ করতে পারেন, যদি তাঁদের আগ্রহ থাকে। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তৈরি পোশাক শিল্পকারখানার মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই সুযোগ নিতে পারেন।’

৫. তৈরি পোশাকশিল্পে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। এই ঘাটতি পূরণে তরুণেরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?

তৈরি পোশাকশিল্পে নানান চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো দক্ষ ও মেধাবী পেশাজীবীর সংকট। সেই সংকট মোকাবিলার জন্য বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফের পরামর্শ, ‘দেশের বাইরের প্রচুর পেশাজীবী এখানে কাজ করছেন। কাজ আছে বলেই তাঁদের সুযোগ আছে। আমাদের তরুণদের সেই সব কাজের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় দক্ষতার সংকট কাটিয়ে তুলতে শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের হাতে–কলমে কাজ শেখার সুযোগ তৈরি করতে হবে।’ তৈরি পোশাক খাতে কাজের জন্য নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা খুব জরুরি। কাজের সুযোগ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ওয়েবসাইট ও লিংকডইনে নজর রাখতে হবে।

৬. উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন?

এই খাতসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা ব্যবহারিক কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে পারে। এমবিএ ডিগ্রি নেওয়া থেকে শুরু করে প্রকৌশল খাতের বিভিন্ন বিষয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও জানার পরিধিকে আরও বড় করা যায়। বিইউএফটির সহ–উপাচার্য আইয়ুব নবী খান বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করছেন। আমরা চীন-ভিয়েতনামের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি। প্রতিবেশী দেশ ভারতও আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা জার্মানি, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়ে ওরা নিশ্চয়ই আরও অবদান রাখতে পারবে।’

৭. কেউ হয়তো সমাজবিজ্ঞানে পড়েছেন, কিংবা ইংরেজিতে স্নাতক করেছেন। এ ধরনের বিষয়গুলোয় পড়ে তৈরি পোশাক খাতে ক্যারিয়ার গড়া যাবে?

শুধু টেক্সটাইল বা মার্চেন্ডাইজিং বিষয়ে পড়লেই তৈরি পোশাকশিল্পে ক্যারিয়ার বিকাশের সুযোগ আছে, এমন একটা ধারণা বাজারে চালু আছে। এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদের মন্তব্য, ‘যাঁরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিষয়, কিংবা মানবিক বিষয়ে ব্যাচেলর করছেন, তাঁদেরও নানা সুযোগ আছে। স্নাতক পড়ার সময় থেকেই তৈরি পোশাক খাতে ক্যারিয়ারের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। ভালো ইংরেজি জানতে হবে, ইংরেজিতে লেখা ও যোগাযোগের কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর অনলাইনে দুই-তিনটি কোর্স করে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন।’

৮. উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ কি আছে?

তৈরি পোশাকশিল্প খাতে ক্যারিয়ার মানেই যে শুধু চাকরি-বাকরি, বিষয়টি এমন নয়। বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘আমাদের ঢাকার সাবেক মেয়র আনিসুল হকের শুরু ছিল কিন্তু তৈরি পোশাক খাতে কাজের মাধ্যমে। এই খাতে মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পেশাজীবী থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে বিকাশের অনেক নজির বাংলাদেশেই আছে। অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানে আমাদের তরুণেরা যেমন কাজ করছেন, ঠিক তেমনি তরুণেরা এই খাতে কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মসংস্থান বিকাশে ভূমিকা রাখছেন।’ তবে আসিফ মনে করেন, সরাসরি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করার আগে কিছুদিন পেশাজীবী হিসেবে কাজ করতে পারলে ভালো। চাকরি করলে অভিজ্ঞতা অর্জন হয়, নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে; যা পরে কাজে লাগে।

৯. শর্ট কোর্স, কর্মশালা, সম্মেলন—এ ধরনের সুযোগ আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন গার্মেন্ট বিজনেস বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। বিস্তারিত: https://iba-du.edu/index.php/media/index/757। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক চেইনশপ ‘টার্গেট অস্ট্রেলিয়া’র সহকারী মার্চেন্ডাইজার মৌমিতা হক বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর তৈরি পোশাকশিল্পসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সম্মেলন ও প্রদর্শনী হয়। এ ধরনের সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক ও নিজের জানা–শোনার পরিধি বিস্তৃত হয়।’ ডেনিম এক্সপো, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস মেশিনারি এক্সিবিশনসহ নানা প্রদর্শনী হয় দেশে। এসব সম্মেলন ও প্রদর্শনীতে অংশ নেয় দেশ-বিদেশের নানা ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠান।

১০. কী ধরনের সফট স্কিল থাকা জরুরি?

সফট স্কিলের গুরুত্ব সম্পর্কে ইউনিক্লো বাংলাদেশ অফিসের (ফাস্ট রিটেইলিং) প্রোডাকশন কো–অর্ডিনেটর রায়হান খন্দকার বলেন, দল পরিচালনার জন্য টিম ম্যানেজমেন্ট, নতুন চ্যালেঞ্জ জয় করার মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া সমস্যা সমাধানের কৌশলগুলো আয়ত্তের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এই খাতে ভালো করতে পারেন। তৈরি পোশাক খাতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ারের জন্য কিছুটা কম্পিউটার শিক্ষা যেমন এমএস এক্সেল, এমএস ওয়ার্ড জানতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজেকে উপস্থাপনের কৌশল জানা। মাতৃভাষা ও ইংরেজিতে নিজের ভাবনা ঠিকঠাকভাবে প্রকাশ করতে হবে। নেগোসিয়েশনের কৌশল জানতে হবে। অশান রিটেইল বাংলাদেশের মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার রণীন আহমেদ বলেন, এখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে হয়, বহুমাত্রিক দল থাকে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি বুঝতে হয়। যাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন, এই খাতে তাঁদের অবারিত সুযোগ আছে।