মনের জানালা

চঞ্চল বোনটি চুপচাপ হয়ে গেছে

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
সমস্যা
আমার ছোট বোন। ছোটবেলায় খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। ভালো গাইতে ও নাচতে পারত। তবে খুব জেদি ছিল। এখন ওর বয়স ২০ বছর। যখন সে দশম শ্রেণিতে পড়ে হঠাৎ ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। মানুষের সঙ্গে কম মেশা, খুব কম কথা বলা, অল্পতেই রেগে যাওয়া, বাড়িতে অতিথি আসা পছন্দ না করা—এসব বেশ চোখে পড়ত। ঘরেই সময় কাটাত বেশি। দিন দিন সমস্যা প্রকট হওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তাঁর পরামর্শে প্রায় পাঁচ মাস চিকিৎসা চলে। কোনো উন্নতি না হওয়ায় বাড়ির কাছে পাবনা মানসিক হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে দেখাই। তাঁর পরামর্শে প্রায় চার বছর চিকিৎসা চলে। কিন্তু তাতেও কোনো উন্নতি না হওয়ায় আমরা খুব ভেঙে পড়ি। কী করব বুঝতে পারছি না। ওর চিকিৎসা এখন বন্ধ আছে, স্বাভাবিক জীবনে নেই সে। আমাদের কোনো কথা রাখে না। কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কী রকম ব্যবহার করতে হয়, বোঝে না। মাকে সহ্য করতে পারে না। আবার অনেক সময় ভালো থাকে। মাকে রান্নায় সহযোগিতা করে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চায়, কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারে না।
এখন আমরা ওকে মানসিক পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দিতে ইচ্ছুক। আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ এমন ছিলেন না। আমরা ওর জন্য কী করতে পারি?
নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
এত অল্প বয়স থেকে তোমার ছোট বোনটার এই দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা সত্যিই খুব দুঃখজনক। এতে করে ওর তো সীমাহীন কষ্ট হচ্ছেই, সেই সঙ্গে বাড়ির সদস্যদেরও প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার ভেতরে থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘ চিকিৎসায় ওর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, এটিও খুব হতাশাজনক। তোমার চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তোমরা ওকে শুধু ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়েছ। সেই সঙ্গে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তোমার বোনের রোগনির্ণয় হয়েছিল কি না, তা উল্লেখ করোনি। ওষুধের সাহায্যে ওর মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে ওর মধ্যে যে নেতিবাচক চিন্তা ও আবেগের সৃষ্টি হয়, সেগুলো নিয়ে ওর মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করাও খুব জরুরি ছিল। সাইকোথেরাপিস্টরা এ ধরনের মানসিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ও সহমর্মী আচরণের মাধ্যমে একটি পেশাগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই কষ্টে থাকা মানুষগুলো তখন জীবনের পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করার সুযোগ পান। তখন তাঁরা নিজেদের মর্যাদা ও আস্থা ফিরে পান এবং নিজেকে একটি গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেন। ফলে তাঁদের মনের ভেতরের কষ্টের ভার তখন অনেকটাই লাঘব হয়। এরপর তাঁদের নানা ধরনের থেরাপিউটিক কৌশলের মাধ্যমে চিন্তা বা ভাবনাগুলো পরিবর্তনে সহায়তা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে শুধু অসুস্থ মানুষটিই নন, তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়েও পারিবারিক থেরাপি সেশন করা হয়। কারণ, অসুস্থ মানুষটি যখন রেগে যাচ্ছেন বা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন, তখন অন্য সদস্যরা সেগুলো নিয়ে প্রায়ই হতাশা ব্যক্ত করেন এবং কখনো কখনো তাঁরাও রেগে যান। এর দ্বারা কষ্টে থাকা মানুষটির রোগ অনেক সময় বেড়ে যায় এবং নিরাময়ের সম্ভাবনাও কমে যেতে থাকে।
কিছু মানসিক অসুস্থতা সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও তাঁরা নিয়মিত কিছু ওষুধ সেবন ও সাইকোথেরাপির সহায়তায় বেশ কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে থাকতে সক্ষম হন। আমি তোমাকে অনুরোধ করব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে চারতলা এবং পাঁচতলায় যথাক্রমে নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট অথবা এডুকেশনাল কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে সেবা গ্রহণের জন্য যোগাযোগ করতে। সেখানে যাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁরা বলে দিতে পারবেন তোমার বোনের চিকিৎসাটি কীভাবে করলে সে উপকৃত হতে পারে।