ছুটি নেই ছুটা বুয়ার

এ বাড়ি-ও বাড়িতে কাজ করে পেট চালান ছুটা বুয়ারা। ছবিতে বাঁ থেকে কুলসুম বেগম, আমেনা বেগম, মরিয়ম বেগম, খালেদা বেগম ও মাজেদা বেগম। ছবি: প্রথম আলো
এ বাড়ি-ও বাড়িতে কাজ করে পেট চালান  ছুটা বুয়ারা। ছবিতে বাঁ থেকে কুলসুম বেগম, আমেনা বেগম, মরিয়ম বেগম, খালেদা বেগম ও মাজেদা বেগম। ছবি: প্রথম আলো

সকাল হতেই ছুট। কোনো বাড়িতে রান্না, কোনো বাড়িতে কাপড় ধোয়া, কোনো বাড়িতে ঘর মোছার কাজ দিয়ে দিনের শুরু। এভাবেই বেলা বাড়ে। এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে কাজ করতে করতেই কেটে যায় সারা দিন। ওঁরা ছুটা বুয়া। ওঁদের ছুটি নেই। সপ্তাহের সাত দিনই দরজায় হাজির ছুটা বুয়া। ঘরে ঢুকেই কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়া। নষ্ট করার মতো সময় নেই এতটুকু। এই করেই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পেট ভরে।

দরজা খুলেই আমরা বলে উঠি, ‘বুয়া, কাপড় ভেজানো আছে ধুয়ে দিয়ো,’ ‘রুটি বানাও,’ ‘ঘরটা কিন্তু ভালো করে মুছবে।’ বুয়াও লেগে পড়েন কাজে। কিন্তু তাঁদের দিনগুলো কেমন কাটে? দিনে কত ঘণ্টা কাজ করেন তাঁরা? বেতনই বা কেমন মেলে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেই একদিন মুখোমুখি হই ছুটা বুয়াদের।

পাঁচ বছর ধরে রাজধানীর তেজতুরী বাজার এলাকায় কাজ করছেন খালেদা বেগম। নিজের নাম কী, তা প্রায় ভুলতে বসেছেন। সবাই ডাকে ‘খালা’। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতেই বুয়া উঠে পড়েন। চলে যান এক বাড়িতে। সেখানে তিন হাজার টাকা বেতন পান তিনি। সকালের নাশতা, দুপুরের তরকারি রান্না করেন। কাপড় ধোয়ার কাজ করেন, ঘর ঝাড় দেন, মোছেন। তড়িঘড়ি দুই ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ করেন খালা। কারণ এর পরই তাঁকে ছুটতে হয় আরেক বাড়িতে। দূরত্ব ১৫ মিনিটের। ছয়তলা সেই ফ্ল্যাটের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম তলায় কাজ করেন তিনি। সারা দিন ধরেই চলে সংসারের খুঁটিনাটি কাজ। বাজারও করে দেন সেই বাড়ির। বিনিময়ে এক হাজার টাকা পান। ওই বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। খাওয়া এক বেলা। এতেই খুশি। কারণ ঘরভাড়া লাগে না। সমস্যা একটাই সারা দিন ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে করতে পায়ের ব্যথায় ভোগেন ৫০ ছুঁই ছুঁই খালা। মাস শেষে যা বেতন পান ভাইকে দিয়ে দেন। তাই দিয়ে চলে অসুস্থ ভাইয়ের সংসার।

কাজে ব্যস্ত খালেদা বেগম। ছবি: প্রথম আলো

ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক খালা কামাই দেন না। নিয়মিত কাজ করতে যান। কেউ বলে নোংরা কাজ। তবে খালার কথা হলো, ‘এত বাড়িতে এত কাজ করলে অত পরিষ্কার করবেন কীভাবে?’

সবাই আবার এই খালার মতো নন। ২৫ বছরের পারুল জানেন, তাঁর কোনো ছুটি নেই। তাই ইচ্ছে করে কামাই করেন। এ বয়সেই তিন সন্তানের মা হয়েছেন—সরল স্বীকারোক্তি তাঁর। বলে ওঠেন, ‘আফা, ছুটি তো নাই। তাই ইচ্ছা কইরাই কামাই দিই। মাসে চার-পাঁচ দিন। ওইটাই ছুটি।’ পারুল কাজ করেন তিন বাড়িতে। কোনো বাড়িতে রান্না, কোনো বাড়িতে কাপড় ধোয়া বা ঘর মোছা। প্রতিটি কাজের জন্য ৫০০ টাকা। রান্নার কাজ ৫০০, কাপড় ধোয়ার কাজ ৫০০। পারুল বলেন, ‘কাজ বেশি হোক। ব্যবহার খারাপ হইলে কাজ করতে মন চায় না।’ তবে পরিষ্কার কাজের জন্য সুনাম আছে তাঁর। পারুলের স্বামী রিকশা চালান। সংসার চালাতে দুজনই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

অনেক বুয়া আবার বাসাবাড়ির ঝক্কিঝামেলা নিতে চান না। তাঁদের পছন্দ মেসের কাজ। রংপুর থেকে আসা বুয়া মাজেদা বেগম যে বস্তিতে থাকেন তার পাশের একটি মেসে কাজ করেন। তাঁর মন্তব্য, ‘ব্যাটারা কিছুই কয় না; যা ইচ্ছা করন যায়। স্বাধীনমতো কাজ করা যায়।’

মেসে এক একজন অমানুষিক পরিশ্রম করেন। ১৪-১৫ জনের রান্না, বাজার, বাসন ধোয়া। বিনিময়ে মাসে দুই কি আড়াই হাজার টাকা মেলে। অনেকে আবার সকাল, বিকেলে দুই মেসে কাজ করেন। করতে হয় মাসের ৩০ দিনই। পরিশ্রম থেকে বাঁচতে অনেকে ইচ্ছে করেই সপ্তাহে এক বা দুই দিন কামাই দেন।

মাজেদা বলেন, ‘হগলে কয় ছুটা বুয়া কামাই দেয়। হামাগের তো ছুটি নাই। তাই কামাই করি।’ মেসে কোনো নির্যাতনের শিকার হন কি না—জানতে চাইলে বলেন, ‘হেরা তো কিছু করে না। তয় মাইনষের কথায় অস্থির। মেসে কাজ করেন, তাই মাজেদাকে নানা কথা শুনতে হয়। মাজেদার স্বামী পঙ্গু। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে। ছেলেকে শিক্ষিত করাই মাজেদার একমাত্র স্বপ্ন।

দিনে পাঁচ-ছয় বাড়িতে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন যে বুয়ারা, তাঁদের আর্থিক অবস্থা কেমন? সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া একজনের স্ট্যাটাস থেকে উঠে আসে বুয়াদের দীনতার কথা। তিনি তাঁর বাড়িতে রাখা এক প্যাকেট মিষ্টি বুয়াকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। বুয়া সেটি নিয়ে যাননি। অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়ে গেলে ছোট মেয়েটি একবারেই সবটা শেষ করবে।’ তাই কাজ শেষে প্রতিদিন ফ্রিজ থেকে দুটি করে মিষ্টি নিয়ে যান। সারা দিন ধরে অপেক্ষার পর মেয়েটি

ছেলেকে শিক্ষিত করতে চান মাজেদা বেগম। সারা দিন তাই মেসে মেসে কাজ করেন। ছবি: প্রথম আলো

পরমানন্দে সেই মিষ্টি খায়। প্রতিদিনই মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আর কয়টি বাকি?’ এভাবেই নিজেদের সংসার টেনে নিয়ে যেতে হয় বুয়াদের। সন্তানের ছোট ছোট চাওয়া খুব কমই পূরণ করতে পারেন তাঁরা।

ময়মনসিংহ থেকে আসা তিনজন বুয়ার সঙ্গে কথা হয়। আমেনা ও মরিয়ম বেগম দুই বোন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও কাজ করে যাচ্ছেন। বেশি কাজ করতে পারেন না। তাই রোজগারও কম। মরিয়ম ও আমেনা কাজ করেন দুই বাসায়। ঘর মোছেন। বাসন মাজেন। এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয়। আমেনার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সংসারে ঠাঁই নেই। তাই ঢাকায় এসেছেন। ঘরভাড়ার টাকা দিয়ে যা পান খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটে।

মরিয়মের গল্পও একইরকম। তিনি থাকেন মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে। বৃদ্ধা শাশুড়ি ও বউ ছুটা কাজ করেন। তাই জামাইটি বেশ আরামেই থাকেন। মন চাইলে রিকশা চালান। না চাইলে নাই।

কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি কাজ করেন দুটি মেস ও দুটি বাড়িতে। গ্রামে স্বামী, সন্তান রয়েছে। স্বামী অসুস্থ। তাঁদের পেট চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন কুলসুম। সকাল, বিকেল কাজ করতে গিয়ে হাতে, পায়ে ব্যথা হয়ে যায়। তাই কুলসুমও কামাই দেন মাঝে মাঝে। নির্দিষ্ট একটি ছুটির দিন থাকলে এমনটা করতে হতো না বলে জানালেন তিনিও। হাসিমুখে বললেন, ‘তাইলে আর বাড়তি ছুটির জন্য কামাই করতে হইত না।’