
একই পরিবারের দুই সন্তান ইতি আর অমিত। দুই ভাইবোনের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই ইতিকে বাসার কাজে সাহায্য না করার জন্য মায়ের কাছে বকা খেতে হয়। প্রথমদিকে ইতি মাকে বলার চেষ্টা করত, অমিতও কিন্তু কাজ করছে না বা অমিতের ঘর কেন ইতি গোছাবে? মা গম্ভীর গলায় বলেছেন, ‘এসব মেয়েদের কাজ! অমিত তো ছেলে! মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই!’
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলিনা প্যারেন্টিং নিয়ে তাদের একটি গবেষণা সম্পর্কে প্রথম লাইনেই লিখেছে, ‘একটা শিশুকে বড় করে তোলা সমাজের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ!’ আর এ সন্তান মানে কিন্তু ছেলে বা মেয়ে আলাদা করে নয়! বাড়ির ছেলেটিকে কাজ শেখালে তার জন্যই ভালো। আত্মনির্ভরশীল তো হয়ই। কাজ ভাগ করে নিতে শেখে। পড়ালেখা বা চাকরির জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। অনেকে বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। গৃহস্থালির কাজের অভ্যাস থাকলে সেটি তখন খুব কাজে লাগে। রান্নাই হোক বা অন্য কিছুই হোক, বাড়তি কোনো চাপ বোধ হয় না।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরাফাত নোমান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মেয়ে সন্তানটিই বাসার কাজ করবে। এমনকি সমাজ ও পরিবার মেয়েটিকে বাধ্য করে ভাবতে যে সে বড় হয় আরেকজনের বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সেবা করবে। মেয়ে বলেই তাকে রান্না করতে হবে, বাসার কাজ শিখতে হবে। অথচ সে হয়তো দেখে তার নিজের ভাইকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না। বাড়ির মুরব্বিরাও অনেক সময় বাবা-মাকে বলেন ছেলেকে দিয়ে কাজ করাচ্ছ কেন? সে তো আর পরের বাড়ি কাজ করবে না!’
মা-বাবার এমন একরোখা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ঠিক নয় বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সন্তান পালনে আসলে আপনি কোন ব্যাপারটিকে কতটুকু গুরুত্ব দেবেন সেটা ভাবতে হবে। সন্তান যখন যা চায় সেটা দেওয়া যেমন খারাপ, তাদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে ফেলাও বিপজ্জনক! সন্তানের মানসিকতা গঠনে তাকে মানুষের মতো ভাবতে বলতে হবে। এই কাজটি ছেলেদের আর এই কাজটি মেয়েদের না বলে সন্তানকে সব কাজ করতে আগ্রহী করে তুলুন। আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অন্যের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।!’
মারুফ মোর্শেদ সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছেন। তিনি পেশায় চিকিৎসক। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাসায় কোনো কাজ করতে হতো না। দেশের বাইরে যাওয়ার পর একদম দিশেহারা লাগত! নিজের সব কাজ নিজেকে করতে হবে, পড়তে হবে, রোগী দেখতে হবে! মনে হয়েছে আগে থেকে কিছু যদি জানতাম জীবনটা সহজ হেতা!’
নেদারল্যান্ডসের রেডবাউন্ড ইউনিভার্সিটি তাদের রিসার্চ অন চিলড্রেনস অ্যান্ড প্যারেন্টিংয়ে লিখেছে, শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও চর্চা সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে তার আশপাশের পরিবেশ ও মা-বাবাকে দেখে বা শুনে। সে মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, সমাজের প্রতি কতটা দায়িত্ববান হবে, ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে—সেটিও সে এখান থেকেই শেখে।