কোনো হ্রদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
কোনো এক সমুদ্রের জলে
পরস্পরের সাথে দু-দণ্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়ন
হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।
—জীবনানন্দ দাশ
জার্মানির ভূখণ্ড নয়টি দেশ ও দুটি সাগর দ্বারা বেষ্টিত। উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ শুনতে হলে উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের পাড়ে যেতে হয় জার্মানদের। জার্মানরা জলপ্রপাতের মতো জল পতনের শব্দ ভীষণ পছন্দ করে। যে কারণে প্রতিটি শহরে কৃত্রিম ফোয়ারা আছে। জলের শব্দ তাদের মনকে আনন্দ দেয়। জার্মান শব্দ ‘সি’ বলতে বোঝায় হ্রদ। পুরো জার্মানিতে ছড়িয়ে আছে প্রায় ৩০ হাজার হ্রদ। এর মধ্যে অনেক হ্রদ স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয়। বিশেষ করে বসন্ত থেকে পুরো গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত পর্যটকদের ভিড় থাকে এসব হ্রদে। অন্য সময়ে স্থানীয় লোকজন হ্রদের পাশের হাঁটাপথ ধরে দৌড়ায়, সাইকেল চালায়, স্কেটিং করে এবং নিরিবিলি সময় কাটায়।
বার্জডোরফার হ্রদ পূর্ব জার্মানির একটি জনপ্রিয় জলাভূমি। ট্রেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাওয়ার সময় প্রথম যেদিন হ্রদটি দেখি, সেদিনই পরিকল্পনা করি ভ্রমণ করার। শহর থেকে ট্রেনে মাত্র আট মিনিট, তারপর হেঁটে যেতে পনেরো মিনিট। শীতের এক সকালে একদিন একাই ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়ি। ট্রেন থেকে নামার পর এক জার্মান ভদ্রলোক আমাকে হাঁটাপথটি দেখিয়ে দেন। আমি তখন কিছু মৌলিক জার্মান ভাষা বলতে শিখেছি। সেটা বুঝতে পেরে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বললেন। হ্রদটি ভ্রমণ করার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, এখানে কী কী প্রজাতির জলচর পাখি আছে, সেটাও দেখা।
হ্রদের কাছে পৌঁছে প্রথমে দেখলাম, হ্রদের মানচিত্র ও ইতিহাস লেখা একটি বোর্ড। মানচিত্রে কোথায় কী আছে, তা উল্লেখ আছে তিনটি ভাষায়। পাড়ে আসার পর ঠান্ডা অনুভূত হলো বেশ। সেদিন ছিল প্রবল বাতাস। ঢেউ আছড়ে পড়ছে কংক্রিটের ব্লকে। এমন ঢেউয়ের শব্দ কেবল সাগরের কাছে গেলে শোনা যায়। টলটলে জল ছুঁয়ে দেখলাম বেশ ঠান্ডা। পাড় ধরে কিছু দূর হাঁটার পরই দেখতে পেলাম শত শত পাতিকুট পাখি। এমন ঠান্ডা পানিতে ভেসে রয়েছে। একটু পরপর ডুব দিয়ে খাবার খায়। পাতিকুট পাখিরা শীতের সময় আমাদের দেশেও পরিযায়ী হয়ে যায়। কিন্তু জানুয়ারি মাসের এ কনকনে শীতে এদের এই ঠান্ডা হ্রদের জলে দেখে একটু অবাক হলাম বৈকি!
তখন শীত, যে কারণে মানুষের পদচারণ কম। হাঁটা শুরু করলাম হ্রদ থেকে ১০ মিটার দূরে পিচঢালা পথ ধরে। এমন পলিশ পিচঢালা হাঁটাপথ দেশে কোথাও দেখিনি। কোনো ধরনের ত্রুটি চোখে পড়ল না। লম্বা সড়কটির একপাশে ঘন গাছপালা। হ্রদের পাড়ে কিছু দূর পরপর বসার বেঞ্চ। অনেক পথিক সেসব বেঞ্চে বসে ঢেউয়ের শব্দ শুনে ক্লান্তি দূর করেন। হ্রদের কিনারে আছে নলবন। এসব নলবনে পাখিরা বাসা বানায়, হ্রদের মাছ ডিম ছাড়ে। ঘাসবনপ্রিয় পাখিরাও থাকে এ বনে। বিশেষ করে গ্রেট রিড ওয়ার্বলার। বসন্তের সময় পুরুষ পাখি উঁচু ও কর্কশ স্বরে ডেকে ডেকে প্রেমিকা খোঁজে। তা ছাড়া এখানে দেখা মেলে অনেক প্রজাতির গাতক পাখি।
শীত, বসন্ত, শরৎ ও গ্রীষ্ম—এই চারটি সময়েই সেখানে গিয়েছি। প্রতিটি সময়ের রূপই স্বতন্ত্র এবং উপভোগ্য। এই হ্রদের ঢেউ ও খোলা প্রান্তর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস ঠিক সমুদ্রের মতোই হৃদয়টা জুড়িয়ে দেয়। এখানকার চারদিকের নীরব পরিবেশ, পাখির গান, পাতার সুরেলা শব্দ এবং রোদের আলোয় জেগে থাকা ঘাস, এক অবাক করার মতো উষ্ণতা দেয় হৃদয়ে। কোনো বনের মধ্যে থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের রোদকে উপভোগ করার মতো একটি জায়গা। হ্যাং চেয়ারে বসে সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য সাগরের অনুভূতি জাগায়। ধ্যান করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। পুরো হ্রদ এলাকাটি সবার জন্য সব সময় উন্মুক্ত।
একটি হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পরিবেশবান্ধব পর্যটন। কেবল বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকালে সচল থাকে এ পর্যটন মৌসুম। তবে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইন্দ্রিয়ের দ্বীপ (আইল্যান্ড অব সেন্স) নামের অবকাশযাপন হোটেল রয়েছে। এটা অন্য সময়ও চালু থাকে। তা ছাড়া আছে ঐতিহ্যবাহী খাবারের নানা রেস্তোরাঁ। সবকিছুর ব্যবস্থাপনা পুরোটাই পরিবেশবান্ধব। চারদিক চকচকে এবং পুরোটাই প্রাকৃতিক।
হ্রদের উত্তর প্রান্তে জলের দুর্গ (ওয়াটার ক্যাসেল টাউচারিটস) নামে একটি ভবন রয়েছে। ১৩০৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে নথিতে আছে। এটা ছিল গড়লিটজ শাসকদের আবাস। এ দুর্গের শেষ বসবাস করা শাসক ছিলেন জোহার ক্রিস্টোফ গটলব ফন ওয়ার্নসডর্ফ। এই দুর্গ মানুষের কাছে জনপ্রিয় এবং রহস্যময় একটি জায়গা।
এখানে আছে শিশুদের খেলার নানা আয়োজন ও বিচ ভলিবল। সাঁতার কাটার জায়গা। দক্ষিণ দিকে ব্লু-লেগুন সৈকত সব পর্যটকের জন্য উপভোগ্য। বিশেষ করে রোদের দিনে নিল জলরাশির মায়া। নৌকা বাওয়া করা এবং নৌকা রাখার জন্য আছে ৬৬ মিটার চওড়া এবং ৫৮৮ মিটার লম্বা পোতাশ্রয়। চারপাশে আছে মনোরম জেটি।
পুরো হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নানা ধরনের নৌকা আছে এখানে। পর্যটকেরা তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করতে পারেন এখান থেকে। ব্লু-লেগুনের কাছে স্নান উপদ্বীপও আকর্ষণীয়। সাধারণত পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। উত্তরের বেলাভূমিতে স্থানীয় লোকজনের ভিড় বেশি থাকে। গড়লিটজ শহরতলির সর্বোচ্চ পর্বত ল্যান্ডক্রোন এখান থেকে ভালো দেখা যায়। উভয় সৈকতের কাছেই আছে ককটেল, আইসক্রিম, বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা, আছে বার।
জার্মান শব্দ বার্জি হলো খুব মোহময়। যে কারণে নামের সঙ্গে বার্জ। তাই তো জায়গাটি প্রশান্তির জন্য ও প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য মানুষের কাছে মোহময়। হ্রদটির আয়তন প্রায় ১ হাজার হেক্টর এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৭২ মিটার। হ্রদটির চারদিকে ১৬ কিলোমিটার পিচঢালা পথ রয়েছে। হাঁটা, সাইক্লিং ও স্কেটিং করার জন্য সড়কটি উপযোগী। আমাদের দেশেও কিছু সুন্দর হ্রদ আছে, যেসব হ্রদ এলাকায় পরিবেশবান্ধব পর্যটন জরুরি।
সৌরভ মাহমুদ: প্রকৃতিবিষয়ক লেখক এবং গবেষক। শিক্ষার্থী, ড্রেসডেন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি।