
মাঘ মাসের শেষ দিকে কমে এসেছে শীত। বাজছে বসন্তের আগমনী বার্তা। তাই হয়তো লোকজন কিছুটা হালকা গরম কাপড়েই এসেছিলেন ডিসি হিল প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যার পর একটু হিমেল হাওয়া বইলেও শীতকে দর্শকের গায়ে লাগতে দেননি শিল্পীরা। আসর জমানো লোকগান, নাচ আর নানা পরিবেশনায় জমজমাট হয়ে উঠেছিল ডিসি হিল প্রাঙ্গণ।
৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ডিসি হিলের নজরুল স্কয়ার মঞ্চে গবেষণাধর্মী সংগঠন সমাজ সমীক্ষা সংঘ পঞ্চমবারের মতো আয়োজন করে দুই দিনব্যাপী ‘লোক সংস্কৃতি উৎসব’। উৎসবে ঢাক-ঢোলবাদন, মাইজভান্ডারি গান, বাউলগান, পালা, কীর্তন ও সাঁওতালি গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ছিল নাচ আর কথামালাও।
‘জ্বালাও আলো, আপন আলো’ স্লোগানে উৎসবের শুরুতে ঢাক-ঢোল ও সানাইয়ের মন মাতানো সুরে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বিনয়বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠীর ঢোলবাদক বাবুল জলদাস ও তাঁর সহশিল্পীরা। এরপর বেলা তিনটায় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় উৎসবের। শহীদ মিনার থেকে ডিসি হিল পর্যন্ত রঙিন মুখোশ, বাংলার লোকজ মটিফ ও ফেস্টুন নিয়ে বের হয় শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার পর উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। এরপরে কাজী মাহমুদ ইমামের সভাপতিত্বে শুরু হয় কথামালা। এতে বক্তব্য দেন উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান আবু তাহের, আবদুল্লাহ আহসান, আবুল হাসনাত মো. বেলাল, আহমেদ খসরু ও কল্লোল দাশ। কথামালার পর অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল হককে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। উৎসবের প্রথম দিন সকাল নয়টায় অনুষ্ঠিত হয় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এর উদ্বোধন করেন শিল্পী মনসুর উল করিম।
কথামালার পর বিকেল চারটায় সমাজ সমীক্ষা সংঘের সাংস্কৃতিক স্কোয়াড শিল্পীরা দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন। তাঁদের পাশাপাশি নাচ পরিবেশন করেন ওডিসি অ্যান্ড টেগর ডান্স মুভমেন্টের শিল্পীরা। বিকেল পাঁচটায় বন্দর ব্যান্ডের পরিবেশনায় শুরু হয় গানের আসর। গানের সঙ্গে প্রমা অবন্তী পরিবেশন করেন লোকনৃত্য।
লোকনৃত্যের পর অনুপম পাল ও বর্ণালি বিশ্বাস পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথের বাউল পর্বের গান। এরপর রাধারমণের গান নিয়ে আসেন সুনামগঞ্জের শিল্পী বিশ্বজিৎ রায়। পল্লিগীতি গেয়ে শোনান আব্দুল আলীমের ছেলে জহির আলীম। মানিকগঞ্জের শিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতি পরিবেশন করেন জারি ও সারি গান। এরপর মাহবুব পিয়ালের পরিচালনায় লোকগান পরিবেশন করে ঢাকা থেকে আসা গানের দল লোকরঙ। এই পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের লোকজ উৎসবের।
উৎসবের শেষ দিন ৬ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটায় মাইজভান্ডারি গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। শিল্পী সৈয়দ মানিক ও তাঁর দলের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় মাইজভান্ডারি গান। এরপরই আয়োজন করা হয় কথামালার। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অতিথি ছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, ব্যবসায়ী মো. শাহাদাত হোসেন। বক্তব্য দেন সংগঠনের পরিচালক শিহাব চৌধুরী, সাইফুদ্দিন মিনহাজ, কাজী মাহমুদ ইমাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আবুল হাসনাত মো. বেলাল। কথামালা শেষে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এরপর পালাগান ‘কমলা রানীর পালা’ পরিবেশন করে নেত্রকোনা থেকে আসা মিলন বয়াতি ও তাঁর দল। পালাগানে গানের পাশাপািশ অভিনয়ও ছিল। এরপর বোতল ও কুলা নৃত্য পরিবেশন করে খাগড়াছড়ি থেকে আসা সংগঠন ইয়ামুক শিল্পীগোষ্ঠী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। বাংলার বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের গান পরিবেশন করেন সিলেট থেকে আগত শিল্পী আবদুর রহমান। ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করে সুনামগঞ্জ থেকে আগত লোকদল শিল্পীগোষ্ঠী। সবশেষে মঞ্চে আসেন কুষ্টিয়া থেকে আগত বাউলশিল্পী শফি মণ্ডল। তাঁর গানের সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত হন দর্শকেরা।