Thank you for trying Sticky AMP!!

তারামন বিবির বাড়িতে

তারামন বিবি
গত ৩০ নভেম্বর চলে গেলেন তারামন বিবি। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য এই যোদ্ধা পেয়েছিলেন বীর প্রতীক খেতাব। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঘুরে এসে স্মরণ করেছেন প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।

বাড়ির সামনে যেতেই স্বাগত জানাল দেয়ালে আঁকা নদী-পাহাড় আর সাদাসিধে গ্রামের কিছু ছবি। মূল ফটকের ওপরের অংশে আঁকা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, দোয়েল পাখি, শাপলা ফুল। সঙ্গে দুজন মানুষের অবয়ব। একজন বীর প্রতীক তারামন বিবি। আরেকটি ছবিতে তাঁর স্বামী আবদুল মজিদ।

ছবিতে তারামন বিবি ডান হাতে রাইফেল উঁচিয়ে ধরে আছেন। নিচে লেখা ‘বীর প্রতীক তারামন বিবি’। তারও নিচে লেখা বাড়ির ঠিকানা—শংকর মাধবপুর, রাজীবপুর, কুড়িগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরী তারামন অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। পুরুষ যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে বীরের মতো লড়েছেন।
তারামন বিবির এই বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ আগেও হয়েছে। আঙিনায় এলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন। এসেই আনন্দের সঙ্গে বলতেন, ‘কখন আইছগো ভাই। ঘরে আইসো।’ তারপর নিজের হাতে আপ্যায়ন করতেন।
১০ ডিসেম্বর বাড়িতে ঢুকেই কেমন যেন খালি খালি লাগল। এগিয়ে যাই তাঁর থাকার ঘরটিতে। সেখানে ঢুকেই শূন্যতা ভর করে। থরে থরে সাজানো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাওয়া সম্মাননা স্মারক আর ছবি। পাশের টেবিলে ওষুধ, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্র। ঘরজুড়ে তারামন বিবির ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র পড়ে আছে।
এক ফাঁকে তারামন বিবির স্বামী আবদুল মজিদ বলে ওঠেন, ‘শুধু মানুষটাই নাই।’ আবদুল মজিদকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন তিনি কতটা সরল মনের মানুষ। সঙ্গীকে হারিয়ে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন, চোখমুখই তা বলে দিচ্ছিল। কথায় কথায় অতীতে ডুব দেন আবদুল মজিদ, ‘হ্যায় যে মুক্তিযোদ্ধা, হেইটা বিয়ের পরও বুঝি নাই। লেহাপড়া নাই। চরের মধ্যে বাড়ি। পেটের ভাত জোগাড় করতেই দিন চইলা যাইত, হেই খবর কেমনে নিমু।’
দম নিয়ে আবার বলেন, ‘আমরা তারামনরে জানতাম তারা বানু। একদিন সাংবাদিক আইসা তারামন বিবিরে খোঁজে। হ্যারাই অনেক কাগজ দেইখা কয়, তারা বানুই হচ্ছে তারামন বানু।’
আমরা জানি সেই ইতিহাসের কিছুটা। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তারামন বিবিকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাঁর খোঁজ মেলেনি। সে সময় ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের সাবেক শিক্ষক বিমল কান্তি দে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাজ করতে গিয়ে তারামন বিবি নামের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম পান। কিন্তু ১১ নম্বর সেক্টরের এই নারী যোদ্ধার ঠিকানা তিনি পাননি। অনেক চেষ্টার পর রাজীবপুরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর সবুর ফারুকী ও সোলায়মান আলীর মাধ্যমে খোঁজ পান তারামন বিবির।

রাজীবপুরের এই বাড়িতেই থাকতেন তারামন বিবি। ছবি: ছুটির দিনে

তাঁকে খুঁজে পাওয়ার খবরটা ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজ–এ প্রকাশ হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তারামন বিবির বীরত্বগাথা। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। এ সময় তারামন বিবির সাহায্যার্থে বিশেষ তহবিল গঠন করে ভোরের কাগজ। পত্রিকাটির কর্মীদের বেতন দিয়ে তহবিল শুরু হয়। এরপর অনেকেই অনুদান প্রদান করেন এ তহবিলে। তহবিলের অর্থ দিয়ে তারামন বিবিকে জমি কিনে দেওয়াসহ নানারকম সহায়তা করা হয়।
আবদুল মজিদ বলেন, ‘ওই সময় বিমল দা, অধ্যাপক সবুর ফারুকী, তাঁর সহযোদ্ধা সোলায়মান ভাই বাড়িতে আইসা সব খুলে বলেন। এরপর সব বদলাইয়া যায়। ভোরের কাগজ–এর তখনকার সম্পাদক মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক) রাজীবপুরে ৩০ শতক জমি কিনা দেন। আরডিআরএস আধা পাকা বাড়ি কইরা দিলে সেখানে আইসা উঠি। আজ সেই জমিতেই তারামন বিবিকে মাটি দিছি।’ শেষের বাক্যটা বলতেই তাঁর চোখে জল গড়ায়।
নিজের স্বপ্নের কথা এক ফাঁকে বলেন আবদুল মজিদ। সে স্বপ্নটি বেশি কিছু নয়, বীরযোদ্ধা স্ত্রীর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার গড়ে তোলার ইচ্ছা আছে তাঁর। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে জাদুঘরে এসে। পাঠাগারের বই পড়ে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে গ্রামের তরুণেরা।
একসময় পাশে দাঁড়ান তারামন বিবির ছেলে আবু তাহের। বলেন, ‘মাকে দেখে অবাক হতাম। এমন একজন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্বিত আমি।’

সহযোদ্ধার স্মৃতিতে তারামন বিবি
ফেরার পথে দেখা হয় তারামন বিবির সহযোদ্ধা সোলেয়মান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের একই গ্রামে বাড়ি। যুদ্ধ করছি একই সঙ্গে। তিনি ২ নম্বর প্লাটুনে আমি ১ নম্বরে।’
তাঁর কথায় মূর্ত হয় তারামন বিবি নামের এক সাহসী যোদ্ধা। ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কোদালকাটিতে আফতাব (আলতাফ) বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে। সেই কোম্পানির হাবিলদার আবদুল মুহিব গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করেন। তিনি তারা বানু নামের এক কিশোরীকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তাঁর বয়স ১৩–১৪ বছর। তারা বানুকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। স্নেহভরে ডাকতেন ‘তারামন’ বলে। রান্নার কাজের পাশাপাশি যুদ্ধকৌশলও শেখান তারামনকে। পরে তাঁর সাহস ও শক্তি দেখে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান। শুধু তা–ই নয়, শত্রুপক্ষের অবস্থান ও তৎপরতা জানতে ছদ্মবেশে ঘুরে খবর সংগ্রহও করতেন তারামন।
গত ৮ নভেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তারামন বিবি। প্রথমে নেওয়া হয় ময়মনসিংহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সেখান থেকে বিকেলে হেলিকপ্টারে ঢাকার সিএমএইচে। কয়েক দিন পর তারামন বিবি বাড়িতে ফিরে যান। ৬২ বছর বয়সে ৩০ নভেম্বর চিরবিদায় নেন মহান মুক্তিযুদ্ধের এক বীর যোদ্ধা তারামন বিবি, বীর প্রতীক।