ঈদ অণুগল্প

তিনি ও ঝিঁঝি পোকা

তিনি ও ঝিঁঝি পোকা
তিনি ও ঝিঁঝি পোকা

বাড়ির নাম মেঘালয়। খুব শখ করে রকিব সাহেব বাড়িটির নাম রেখেছিলেন। ছোট্ট দোতলা বাড়িটি চারপাশে বড় বড় গাছপালা আর লতাপাতায় জঙ্গল। কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। দোতলার টানা বারান্দা থেকে শুধু পুরোনো একটি রকিং চেয়ারের দুলুনির ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ  সেই শব্দও থেমে গেল। রকিব সাহেব হাতের ঘড়ি দেখলেন। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। তাঁর মেয়ের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তিনি রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।নিঝুম এই বাড়িতে শুধু দুটি মাত্র প্রাণীর বসবাস। রকিব সাহেব ও তাঁর একমাত্র মেয়ে মেঘা। রকিব সাহেব ধীর পায়ে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। বিশাল বড় খাটটার মাঝখানে মেয়েটি জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রোগাক্রান্ত শীর্ণ শরীরটা যেন খাটের সঙ্গে মিশে গেছে। রকিব সাহেব মৃদু গলায় ডাকলেন, ‘মেঘা, মা আমার। আমার পুতুল সোনা, ওষুধ খাবি না?’ মেঘা আস্তে করে চোখের পাতা খুলে বাবাকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। রকিব সাহেব তাড়াতাড়ি মেয়েকে এসে ধরলেন। মেয়েকে দুই হাত দিয়ে ধরে বসিয়ে দিলেন। এটুকু পরিশ্রমেই মেঘা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে, বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগে তাঁর। দুই বছর ধরে মেয়েটির ক্যানসার। দীর্ঘ কেমোথেরাপির প্রভাবে মেয়েটির শরীরে কিছুই নেই। মাথাভরা চুল ছিল মেয়েটির, এখন তার কিছুই নেই। ছোট্ট শুকনা মুখটায় শুধু বড় বড় টানা টানা চোখ দুটো তার দিকে তাকিয়ে হাজারো প্রশ্ন করে। তিনি নির্বাক হয়ে মায়াভরা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বড় অসহায় বোধ করেন। কী বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দেবেন বুঝে পান না। মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর মেয়ের জীবনের সব আরও মুছে যাচ্ছে ভাবতেই তাঁর বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে যায়। মা-হারা মেয়েটাকে তিনি বড় আদর দিয়ে মানুষ করেছিলেন। হঠাৎ  কী যে হলো, সবকিছু কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিয়েছেন। আর কিছুদিন পরই হয়তো তাঁর পুতুলের মতো মেয়েটি...রকিব সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনি ধীর পায়ে বারান্দায় ফিরে আসেন। রকিং চেয়ারটাতে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বুকের মাঝে তীব্র ব্যথা বোধ হয় তাঁর। সব বাড়িতে আজ আলো ঝলমল করছে। শুধু তাঁর বাড়িতে অন্ধকার। চোখ বন্ধ করে তিনি আশপাশের বাড়িগুলোর কলরব শুনতে পান। সব খানে আজ ঈদের খুশি, কিন্তু তাঁর এই অভিশপ্ত বাড়িতে শুধু অসীম নিস্তব্ধতা। সাত বছর আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন, তারও আগে বাবা-মা চলে গেছেন। দুটি মাত্র বোন তাঁর, তাঁরাও কেউ বেঁচে নেই। আত্মীয়স্বজন সবাই আজ কত দূরে। একটি মাত্র সন্তান মরণব্যাধিতে ভুগছে। তাঁর মেয়েটির জীবন তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো হতে পারত। পাশের বাড়ির রুনু মেয়েটির মতো তাঁর মেয়েটিও হয়তো আজ লাল শাড়ি, লাল টিপ পরে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা বেণি দুলিয়ে বলতে পারত, দেখো তো বাবা, আমায় কেমন দেখাচ্ছে? অথচ আজ মেয়েটি তাঁর পাশের ঘরে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। মেঘা যে বড় লাল শাড়ি ভালোবাসত। প্রতি ঈদে সে বাবার কাছে চওড়া পাড়ের লাল শাড়ির বায়না ধরত। এবারও রকিব সাহেব মেয়ের জন্য লাল শাড়ি কিনেছেন। মনে ক্ষীণ আশা, মেয়েটি হয়তো হঠাৎ  করে বিছানা ছেড়ে এসে বলবে, বাবা, আমার শাড়ি কই?

রকিব সাহেবের দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। বাকি জীবনটুকু এই নিঝুমপুরীতে তিনি কীভাবে কাটাবেন, কার জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন? তার একাকিত্ব কাটাতেই হয়তো বাইরে ঝিঁঝি পোকা ডাকে। রকিব সাহেব স্বস্তিবোধ করেন। খুব চেনা এই ডাকের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ঝিঁঝি পোকারাই এখন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। রাত যত বাড়তে থাকে, ঝিঁঝি পোকার ডাকও বাড়তে থাকে। এই বাড়িতে এখন শুধু তিনি, মেঘা আর ঝিঁঝি পোকার ডাক...।

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক