বকুল ফুলের গাছকে বলা যেতে পারে একটি মায়াবতী বৃক্ষ। তার ফুলের যে শুধু গন্ধে মায়া, বর্ণে মায়া তা নয়। তার পাতায় পাতায়ও একই বিনীত নিবেদন। রাতে ফুল ফোটে আর সারা রাত টুপটাপ ঝরে, ভোরে কিশোরী মালা গাঁথবে বলে। আবার ফুল ঝরলেও সে কখনো পাতা ঝরিয়ে উদোম হয় না, শুধু ক্লান্ত পথিককে একটু ছায়া দেওয়ার জন্য কিংবা ‘যেখানে প্রেমিক মিলবে, প্রেমিকার সাথে ঠিকই’। তারার মতো দেখতে এই ফুলের কথাই কি নজরুল বলেছেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেবো খোঁপায় তারার ফুল?’
রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রিয় ফুলের একটি ছিল নাকি বকুল। পদ্মাপারের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তিনি লাগিয়েছিলেন বকুলগাছ। আর সেই বকুলতলায় বসে কবি লিখেছেন, ‘ওগো, নির্জনে বকুল শাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে?/
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল/ আঁচল আকাশে হতেছে আকুল/ উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক-/কবরী খসিয়া খুলিছে।’
বকুলশাখায় কে যেন একাকী দোলনায় দোল খাচ্ছে। সেই দোলায় বকুল ফুল ঝরে পড়ছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল এভাবে ওপরের দিকে উড়ছে, যেন আকাশের জন্য সে আকুল। বাতাসে চুল উড়ে তার দুচোখ ঢেকে যাচ্ছে, সেই হাওয়ায় তার খোঁপা খুলে পড়ছে। কে দোলে কবির মনের ঝুলনায়? চারুলতা?
এই ছোট্ট বকুল। ঝরে পড়াতেই যার সার্থকতা। তাকে নিয়ে কত কথা, কত প্রেম, কত বিরহ। সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম, হাত ভরা বকুল ফুলের ছবির নিচে একজন লিখেছেন, ‘আমার শৈশবের সাথে মিশে থাকা একটি ফুল। এখনো যেখানেই পাই, বকুল ফুল কুড়াই, মালা গাঁথি।’
বকুল যে শুধু ফুল, তা নয়। সে ফল, সে আয়ুর্বেদী বৃক্ষও বটে। এই ছায়াতরুর কষা ফল পাখির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পথে যেতে যেতে স্কুলগামী শিশুও খায়। বকুলের পাতা সেদ্ধ করে মাথায় দিলে নাকি মাথাব্যথা কমে যায়। পাতার রসও নাকি চোখের জন্য উপকারী। কাঁচা বকুলের ফল প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি করে চিবিয়ে খেলে নাকি শক্ত হয় দাঁতের গোড়া।
বকুল ফুলের আরেক নাম মধুপুষ্প। এই মধুগন্ধা বা মধুপুষ্প রসে নাকি হৃদ্যন্ত্রের নানা রোগ সারে। মনের রোগও উপশম হয় এই ফুলের ছোঁয়ায়। তাই তো বকুল ফুল দিয়ে হাত বাঁধে তরুণী। বইয়ের ভাঁজে ব্যর্থ প্রেমিক প্রেম খুঁজে মরে। কবি বিনয় মজুমদার লেখেন, ‘বকুলের মতো শেষে/ শুকিয়ে খয়েরি হয়ে, দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মালিকায়/ কোনদিন আসবে কি?’ এমন মমতা যার পরতে পরতে, সেই বকুলের কথা শুনে অলি তো হেসে উঠবেই। সেই স্প্যানিশ চেরি বা বকুলের জন্য প্রিয়া তো গাইবেই,
‘বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেব তার সুরভী
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি
আমি মিনতি করে গেলাম।’
এই মিনতি উপেক্ষা করে-সাধ্য কার।