মুক্তিযুদ্ধের যে ঘটনা শিহরণ জাগায়

দাদির অপেক্ষা

>

যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, মুক্তিযুদ্ধের কোন ঘটনা তাঁদের আলোড়িত করে? ভাবায়, সাহস জোগায়? বড়দের মুখে শোনা, বইয়ে পড়া কিংবা নিজের পরিবারে ঘটে যাওয়া এমনই কিছু ঘটনা লিখেছেন এই প্রজন্মের কয়েকজন তরুণ।

সে সময়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহ​িসকতার গল্প এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনু​প্রাণিত করে। ছবি: সংগৃহীত
সে সময়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহ​িসকতার গল্প এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনু​প্রাণিত করে। ছবি: সংগৃহীত


গল্পটা আমার দাদির মুখে শোনা।

মাদারীপুর জেলার (তৎকালীন মহকুমা) কালকিনি উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যম নেই। গ্রামে শোর পড়ে গেছে, ‘টাউনে মিলিটারি আইছে।’ কিন্তু কেউ জানত না যে সেদিনই মিলিটারি এই অজপাড়াগাঁয়েও পৌঁছে যাবে। প্রতিদিনের মতো স্নান সেরে হরিচরণ বৈদ্য দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। এরই মধ্যে শোরগোল শোনা গেল, ‘বাইনের বাড়ি মিলিটারি আইছে।’ পরপর কয়েকটি গুলির শব্দ, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। বোঝা গেল, কাচাঘরগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে।

গ্রামের মাতব্বর হিসেবে হরিচরণ ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। কাঁধে গামছা ফেলে পাশের বাড়ির বুধাইর বাপকে নিয়ে নৌকাযোগে ছুটলেন। কে জানত, এটাই তাঁর শেষ যাত্রা ছিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর পরপরই মাঝপথে নৌকা আটকে মিলিটারিরা তাকে তুলে নেয়।

নৌকায় থাকা আটক ব্যক্তিদের একজন প্রাণ বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর হাতে একটি গুলি লেগেছিল, কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

এরপর আমাদের গ্রামের প্রতিটি দিন দুঃসহ কেটেছে। বাড়ির নারী-পুরুষ সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য পানির মধ্যে কচুরিপানা মাথায় নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। ‘মিলিটারি আসতেছে’ এ কথা প্রচার করে সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে যুদ্ধ চলাকালে তিনবার ঘরবাড়ি লুটও হয়েছে।

তারপরও গামছা কাঁধে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া মানুষটির ফিরে আসার প্রতীক্ষায় সবাই অধীর আগ্রহে বসে থাকত। আমার পিসি তখন খুব ছোট ছিলেন। ছোট্ট মেয়েটার দৃষ্টি সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বাবাকে (আমার দাদু) খুঁজত। আমার বাবা-চাচারা অনেক ছোট ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেছিলেন দাদুর খবর নেওয়ার জন্য। কিন্তু পাওয়া যায়নি।

শোনা গেছে তাঁদের ধরে নিয়ে কিছুদিন আটকে রেখে অনেকের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও দাদি শাঁখা-সিঁদুর পরতেন। বছর খানেক পর সে সময়ের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফেরা একজন খবর দিলেন, মাদারীপুর জুটমিলে দাদুকে হত্যা করা হয়েছে।

ছোটবেলায় এসব কথা দাদি যখন আমাদের শোনাতেন, তখন মনের অজান্তেই তাঁর চোখের কোণে পানি চলে আসত। পাশে বসে থাকা পিসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার অর্থ তখন হয়তো বুঝতাম না। কিন্তু এখন যখন জুটমিলের সামনে দিয়ে যাই, তখন আমারও কান্না পায়। আর মনে হয় দাদু আবার ফিরে আসবেন। আজ দাদি বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর মরার আগ পর্যন্ত তাঁকে কখনো মন খুলে হাসতে দেখিনি। গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবতেন।

আমার দাদুও দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখেছিলেন, ভাবতেই গর্ব হয়।