নকশালবাড়ি আন্দোলনের আঁতুড়ঘরে

নিপীড়িত মানুষের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে বেঙ্গাইজোত গ্রামে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
নিপীড়িত মানুষের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে বেঙ্গাইজোত গ্রামে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

নকশালবাড়ি একটি আন্দোলনের নাম। নকশালবাড়ি একটি আদর্শের নাম। একটি লড়াইয়ের নাম। এই লড়াই শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি থানা এলাকায়। নকশালবাড়ি নেপাল সীমান্তঘেঁষা সীমান্ত নদী মেচির ভারতীয় তীরের একটি থানা শহর। ২০১৭ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সেই আন্দোলনের আঁতুড়ঘর এখন কেমন আছে, তা দেখতেই গত ডিসেম্বরে নকশালবাড়িতে যাওয়া। যেখানে একদিন তির-ধনুক, বর্শা, দা, কাটারি আর অস্ত্র নিয়ে ভূমিহীনেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জোতদারদের বিরুদ্ধে।

১৯৬৭ সালের মে মাসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালসহ বেশ কজন বিপ্লবী। আজ তাঁদের কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু বেঁচে আছে সেদিনের নকশালবাড়ি আন্দোলনের আদর্শ এবং তত্ত্ব। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতা কানু সান্যাল আর জঙ্গল সাঁওতালদের বাড়ি, সেই নকশালবাড়ির শিবদাল্লা গ্রামে।

কলকাতা থেকে ট্রেনে সোজা চলে আসি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। সেখান থেকে গাড়িতে করে শিলিগুড়ি শহর। তারপর একটি ট্যাক্সি নিয়ে পাড়ি জমাই নকশালবাড়িতে। নকশালবাড়ির পাশ দিয়ে নেপাল-ভারত সীমান্ত বরাবর বয়ে চলেছে মেচি নদী। এর এক পাড়ে নকশালবাড়ি আর অন্য পাড়ে নেপালের কাঁকরভিটা। আমরা নকশালবাড়ি থানার পাশ দিয়ে প্রথমেই চলে যাই ঐতিহাসিক বেঙ্গাইজোত গ্রামে। এই বেঙ্গাইজোত গ্রামে ১৯৬৭ সালের ২৫ মে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে জড়ো হয়েছিলেন ভূমিহীন কৃষকেরা। হুংকার তুলেছিলেন লাঙল যার জমি তার, নকশালবাড়ির পথ বিপ্লবের পথ, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস ইত্যাদি স্লোগানে। বেঙ্গাইজোত গ্রামকে আজ বলা হয় নকশালবাড়ি আন্দোলনের আঁতুড়ঘর।

নকশালবাড়ি আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ

বেঙ্গাইজোত গ্রামও আজ পাল্টে গেছে। রাস্তার দুই ধারে বাড়িঘর হয়েছে। ৫০ বছর আগে এই চেহারা ছিল না। এখানে রয়েছে বেঙ্গাইজোত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয় ঘিরে সেই ১৯৬৭ সালের ২৫ মে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো কৃষক, শ্রমজীবী, বিপ্লবী। এর আগে এই আন্দোলনকারীদের তিরের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন নকশালবাড়ি থানার ইন্সপেক্টর তেনজিং ওয়াংদি। ফলে নকশালবাড়ির পুলিশ সেদিন আন্দোলনকারীদের খতম করার জন্য তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল। পথ খুঁজছিল কীভাবে বেঙ্গাইজোত গিয়ে ভেঙে চুরমার করে দেবে আন্দোলনকে। নকশালবাড়ি থানা থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে বেঙ্গাইজোত গ্রাম। ব্যস, পুলিশ ছুটে যায় সেখানে। তারপর পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। রক্তাক্ত হয় বেঙ্গাইজোত গ্রাম। এখানে শহীদ হন নয়জন এবং দুটি শিশু।

এই ঘটনার পর দিকে দিকে জ্বলে ওঠে আগুন। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন কমিউনিস্টরা। সঙ্গে থাকেন কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালেরা।

গ্রামের নেতারা পুলিশ আসার খবর পেয়ে নারীদের সামনে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আটজন নারী। ছিলেন একজন পুরুষ আর দুই শিশু।

শহীদদের স্মরণে নকশালবাড়িতে গড়া হয়েছে স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের পাশে কথা হলো একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নৃপেন বর্মণের সঙ্গে। তাঁর কাছে জানা গেল, প্রতিবছর ২৫ মে এখানে নকশাল আন্দোলনের অনুষ্ঠান হয়, স্মরণ করা হয় এই বীর শহীদদের। বিরাট মিছিলও হয়।

আমরা এই স্মৃতিসৌধের পাশে দেখলাম আরও কয়েকটি স্মৃতিস্মারক। রয়েছে তাঁদের মধ্যে লেনিন, স্তালিন, মাও সে-তুং, লিন পিয়াও, চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত ও মহাদেব মুখার্জির আবক্ষ মূর্তি।

নৃপেন বর্মণ জানালেন, একটু সামনে গিয়ে আপনাদের ডান হাতে যে বাড়িটি পড়ছে, সেটি হলো সেদিনের শহীদ হওয়া ধনেশ্বরী দেবীর বাসভবন। এখানেই তাঁর স্বামী প্রহ্লাদ সিং নকশাল আন্দোলনের পতাকাতলে এসে চারু মজুমদার আর কানু সান্যালের সঙ্গী হয়েছিলেন। আজ তিনি বেঁচে নেই। আছেন তাঁর পুত্র পবন সিং।

পবন সিংয়ের বয়স এখন ৭৬ বছর। আমরা কথাও বললাম তাঁর সঙ্গে। তিনি শোনালেন সেদিনের পুলিশের হামলা এবং ১১ জন শহীদ হওয়ার কাহিনি। বললেন, ‘মা ধনেশ্বরী দেবী কমিউনিস্ট মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে চারু মজুমদারের আদর্শে নেমেছিলেন জোতদারদের বিরুদ্ধে জমি দখল আন্দোলনে। মা-বাবার আদর্শ আঁকড়ে ধরে এখনো বেঁচে আছি।’

বেঙ্গাইজোত ছেড়ে ফেরার পথে চলে আসি কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালদের স্মৃতিবাহী গ্রাম শিবদাল্লায়। এখানে আছে কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালের বসতবাড়ি। কানু সান্যালের বাড়িটি এখন করা হয়েছে কানু সান্যাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ভবন। পাশেই জঙ্গল সাঁওতালের বাড়িটি ভগ্নাবস্থায় পড়ে আছে। বাড়িতে রয়েছে জঙ্গল সাঁওতালের নাতি।

নকশালবাড়ি দেখে আর নকশালবাড়ির সেদিনের আন্দোলনের কথা মাথায় নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। শুধু জেগে রইল নকশালবাড়ির এক টুকরো স্মৃতি।