>সৈয়দ শামসুল হককে বলা হয় সব্যসাচী লেখক। যাঁর লেখনী অজস্র বাঙালি পাঠককে মুগ্ধ করেছে, সেই তিনিও একদিন মনে মনে বলেছিলেন, ‘লেখার মুখে ছাই! কলমের ওপর ঘেন্না! সাহিত্য আর আমার জন্যে নয়!’ সমালোচনা থেকে কীভাবে তিনি শক্তি খুঁজে পেলেন, সে কথাই তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। পড়ুন প্রথমা প্রকাশন থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনী, ‘তিন পয়সার জোছনা’র একাংশ।

পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে আমার গল্প পড়বার সন্ধ্যা-জমজমাট আসর, লেখকের ভিড়ে উপচে পড়েছে সওগাত প্রেসের সেই গুদামঘরটি, কাজী মোতাহার হোসেন সভাপতির আসনে ধ্যানস্থ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে মনে পড়ে, বসে আছেন জোড়াসন হয়ে, শুদ্ধ শান্তিনিকেতনি উচ্চারণে কথা বলছেন পাশের জনের সঙ্গে, তাঁর সে উচ্চারণ শুনেই আমার হৃৎকম্প—এঁদের মধ্যে আমার রংপুরি জিহ্বায় বাংলা!—লোহানী বসেছেন বিখ্যাত সব মানুষদের গা ঘেঁষে, তবে তাঁর অভ্যেস নয় এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির থাকা, মাঝে মাঝেই উঠে যাচ্ছেন, আবার আসছেন, মন দিয়ে কিছু শুনছেন কি না বলবার জো নেই—আর—পাঠ করা সব লেখারই বাঁধা সমালোচক খালেদ চৌধুরী নিমীলিত নেত্রে বসে আছেন বাবুটি হয়ে, ধীরে ধীরে পান চিবোচ্ছেন, তাঁর নেত্র দুটি অপরাহ্ণেই মহাতামাক নেশাক্রমে টকটকে রাঙা—লোহানীর মুখে আগেই শুনেছি এ তামাকে খালেদ চৌধুরীর বিস্তার খোলে!—আমি পড়ে চলেছি ‘শেষের কবিতার পরের কবিতা’, প্রায় আঠারো-কুড়ি পাতার ছিল সেই গল্পটা। তখন ও সভায় লেখা পড়তে বা আলোচনা করতে উঠে দাঁড়াবার রেওয়াজ ছিল না—বসে বসেই সব!
প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জন লেখক—বসে আছেন উৎকর্ণ হয়ে—জবুথবু গলায় আমি পড়ে চলেছি পাতার পর পাতা, একসময় পড়া শেষ হলো, পিনপতন স্তব্ধতা, কারও মুখে ভাবান্তর নেই, আলোচনা করবার জন্যে সভাপতি কাজী মোতাহার হোসেন নীরব নির্দেশে খালেদ চৌধুরীর দিকে তাকালেন, ধ্যানস্থ খালেদের সেটি দেখে ওঠার কথা নয়, কিন্তু তিনি জানেন বলতে হবে তাঁকেই—তিনি চোখ দুটি ধীরে খুললেন, ধীরেই তাঁর পানরসস্থ ঠোঁট খুলল, তারপর গড়িয়ে পড়ল অস্ফুট উচ্চারিত দুটি শব্দ—গুহাযুগ! আমি হকচকিয়ে গেলাম—গল্পের আলোচনা করতে গিয়ে গুহাযুগ? ঠিক শুনছি তো?
কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে খালেদ শুরু করলেন, মানবসভ্যতার সেই আদিম কাল—গুহাযুগ থেকে লৌহযুগ, তাম্রযুগ, আগুনের আবিষ্কার, ফিনিশীয়দের হাতে লিপির উদ্ভব—তিনি বলে চললেন, বলেই চললেন—আর আমিও ক্রমেই উদ্বেল হতে থাকলাম—দেখেছ! এমন একটা গল্প লিখেছি যে তার আলোচনা করতে গিয়ে পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাসটাই বয়ান করতে হচ্ছে এমন দুর্দান্ত ধীমান এক সমালোচককে! গর্বে আমি ইতিউতি চাইছি, আর শুনে চলেছি—খালেদ উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব পেরিয়ে, কার্ল মার্ক্সের দর্শন ছুঁয়ে, সভ্যতার ইতিহাস যে হাতিয়ারেরই ইতিহাস আসলে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে একটু থামলেন—তারপর কাজী মোহাতার হোসেন সাহেবের দিকে নেত্র দুটি স্থির স্থাপন করে বললেন, সম্মানিত সভাপতি, যে গল্পটি এইমাত্র পড়া হলো, মানবের এই দীর্ঘ ইতিহাসে এর চেয়ে নিকৃষ্টতম গল্প আর হয় না, বোধ করি হবেও না!
নিঃশব্দে বজ্রপাত হয়ে গেল আমার মাথায়। সভাজুড়ে কুলকুল হাসি উঠল, তারপর কেউ একজন কী একটা পাঠ শুরু করলেন, সভা ফিরে গেল নিবিষ্ট শ্রবণে, আর আমি?—আমি তো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি না, দয়াবতী ধরণিও আমাকে গ্রাস করবে না, নিজেকে সবার অলক্ষ্যে ঠেলে ঠেলে সভার একেবারে শেষ প্রান্তে দরোজার কাছে নিয়ে মাথা নিচু করে গুটিয়ে বসে রইলাম। সভা একসময় শেষ হলো, নিঃশব্দে আমি দ্রুত বেরিয়ে এলাম যে কারও চোখে পড়বার আগেই পালিয়ে যাব—পারলাম না, সবাই হইহই করে বেরোতে শুরু করেছেন, আমি প্রেসের বাইরে ডালিমগাছটির আড়ালে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়লাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম কতক্ষণে সবাই চলে যাবে আর আমি বাড়ি ফিরে যাব।
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি—লেখার মুখে ছাই! কলমের ওপর ঘেন্না! সাহিত্য আর আমার জন্যে নয়! হঠাৎ কাঁধের ওপর কার যেন হাত—আমি চমকে উঠলাম—তাকিয়ে দেখি ফজলে লোহানী! তিনি বললেন, কী! মন খারাপ? আমার কানে তা পশেছে কি পশে নাই, চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়তে লাগল পানি। সমুখ দিয়ে ওই যে কবি আর লেখকেরা কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাচ্ছেন যেন মন্দাকিনীরই স্রোত—লোহানী ওঁদের দিকে হাত তুলে বললেন, ওই যে ওদের দেখছ, একদিন ওরা কেউ থাকবে না! তারপর আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন, তুমি থাকবে! বললেন, এসো তুমি আমার সঙ্গে।
(সংক্ষেপিত)