
বছর বিশের জেরিন ফারজানা। সবার কাছে পরিচিত ময়না নামে। মুখে সব সময় হাসি। এই হাসিতে জয় করে চলেছেন পর্যটকদের মন।
কক্সবাজারের পর্যটনপল্লি দরিয়ানগরে সপরিবারে কোনো পর্যটক দল এলে ডাক পড়ে তাঁর। ময়না তাঁদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান সারা কক্সবাজার।
ময়না পর্যটকদের গাইড। পর্যটননগর খ্যাত কক্সবাজারে কাজ করা প্রায় ৩০০ গাইডের মধ্যে ময়না একমাত্র নারী।
ময়না পর্যটকদের নিয়ে যান কখনো হিমছড়ির ঝরনায় কিংবা ইনানীর পাথুরে সৈকতে। শহর ছেড়ে রামুর বৌদ্ধপল্লি, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, সোনাদিয়া লাল কাঁকড়ার দ্বীপ, আদিনাথ মন্দির ও টেকনাফের মাথিনের কূপে। শহরের ভেতরের নানা স্থান তো আছেই। সব আয়োজন সামলান তিনি। তাতে খুশি পর্যটকেরাও। অনেকে পরিবারের সঙ্গে আপন করে নেন তাঁকেও। মুঠোফোনে থাকে যোগাযোগ। তাঁরা কক্সবাজার এলেই ময়না ছাড়া যেন চলেই না।
১০ অক্টোবর কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের দরিয়ানগরে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নানা প্রতিকূলতা, তার ওপর রক্ষণশীল সমাজ। কীভাবে ময়না জড়িয়ে পড়লেন এই পেশায়? শুনুন ময়নার মুখে—‘জীবনের প্রয়োজনে এই পেশায় জড়িয়ে পড়েছি। আমি যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, তখন বাবা আমাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যান। মা অসুস্থ। ছোট দুই ভাইবোন লেখাপড়া করে। আমি পড়ার ফঁাকে শখের বশে পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করতাম। তারা সামান্য বকশিশ দিত। এতেই খুশি হতাম। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর লেখাপড়া বাদ। আয়-রোজগারের জন্য নেমে পড়লাম গাইড হিসেবে।’
কথা বলার ফাঁকে মুঠোফোনে সেরে নিচ্ছেন নিজের কিছু কাজ। কারণ, কিছুক্ষণ পরই তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হবে সপরিবারে আসা একদল পর্যটক নিয়ে।
ময়না বলেন, ‘সাত বছর বয়স থেকে পর্যটকদের পথ দেখানোর এই সেবা দিয়ে চলেছি। আগে ছোট ছিলাম, নারী–পুরুষ সবাইকে সেবা দিতে পারতাম। এখন বড় হয়েছি, তাই ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে (সপরিবারে) যাঁরা ঘুরতে আসেন, শুধু তাঁদের গাইড করি। অন্যথায় লোকজনের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সমালোচনা না থাকলে এলাকার অনেক মেয়ে এই পেশায় আসত।’
ময়না সারা দিন ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকলেও সব সময় খোঁজ রাখেন মা মনোয়ারা বেগম ও ছোট দুই বোন—সুইটি ও উর্ভাবের। দুই বোনকে লেখাপড়া করিয়ে ভালোভাবে চলার পথ করে দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর। সুইটি দরিয়ানগরের বড়ছড়া গ্রামের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কলাতলী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণি আর উর্ভাব বাড়ির পাশের বড়ছড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
ময়না জানান, সারা দিন পর্যটকদের নিয়ে জেলার টেকনাফ, ইনানী, হিমছড়ি, মহেশখালী, সোনাদিয়া, রামু, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ঘুরতে হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনো বিকেল বা সন্ধ্যা। পর্যটকেরা খুশি হয়ে বকশিশ হিসেবে যা দেন, তাই দিয়ে চলে সংসার। পর্যটক না থাকলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
দরিয়ানগর পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণে আসা নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী আকমল হোসেন বলেন, ‘আট বছর আগে এখানে ঘুরতে এসে ময়নাকে আবিষ্কার করেছিলাম। তখন সে ১২ বছরের কিশোরী। এখন অনেক বড় হয়েছে। ময়নার ব্যবহারে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ। প্রতিবছর কক্সবাজার এলেই ময়না আমাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়।’
দরিয়ানগর পর্যটনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোস্তাক আহমদ জানান, সাত-আট বছর বয়স থেকেই ময়না দরিয়ানগরে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর ব্যবহারে পর্যটকেরা খুশি। ময়না ছাড়া কক্সবাজারে অন্য কোনো মেয়ে গাইড নেই। ময়নার মতো অন্য মেয়েরাও এই পেশায় এলে পর্যটনশিল্পের উন্নতি হতো।
আবার ফিরে আসি কাজের কথায়। ময়নার স্বপ্ন এলাকার মেয়েদের নিয়ে আলাদা একটি ‘গাইড দল’ গঠন করা। কিন্তু টাকার অভাবে তাতে সফল হচ্ছেন না। তারপরও দমার পাত্র নন তিনি। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন স্বামী সোহেল রানা। কয়েক মাস আগে সংসার পাতেন তাঁরা। স্বামীর হাত ধরে পর্যটকদের জন্য সেবার পরিধি বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংকল্প এখন ময়নার।