পাঠকের ফিচার: ফেসবুক

.

হারিয়ে খুঁজি

সামিরা তাবাসসুম তালুকদার
ইমনের বয়স ১৫ কি ১৬ বছর। ছেলেটা খুব ফেসবুক অ্যাডিক্টেড। দিনের অনেকটা সময়ই ফেসবুক নিয়ে কাটায়। একদিন ওর অ্যাকাউন্টে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। ফেইক নাম, ফেইক ছবি। তাও ইমন রিকোয়েস্টটা একসেপ্ট করল। কয়েক দিন ফেইক মানুষটার সঙ্গে কথাও হলো ইমনের। জানা গেল, এটা একটি মেয়ের অ্যাকাউন্ট। তাঁর বয়স ৩৫ কি ৩৬ বছর। ধীরে ধীরে ইমনের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠল। যখন ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ইমনের কথা হতো, তখন ইমনের কেন যেন খুব মায়ের কথা মনে পড়ত। ইমনের বয়স যখন পাঁচ, তখন ওর মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মায়ের মরদেহ দাফন করার কয়েক দিনের মধ্যেই ইমনের বাবা ওকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে ও বাবার কাছেই মানুষ। মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সব সময় ইমনের মনটা কেমন যেন ছটফট করত। কিন্তু এই অচেনা ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলার সময় মনের এ ব্যথাটা যেন হৃদয়ের কোথাও লুকিয়ে যেত।
ফেসবুকে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর একটা ছেলে ছিল। কিন্তু ছেলেটা একদিন হারিয়ে যায়। ভদ্রমহিলা ছেলেটাকে কত খুঁজলেন, কোথাও পাওয়া গেল না। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জানো, আমার ছেলেটা থাকলে না এখন তোমার বয়সীই হতো।’
ইমন ঠিক করল, সে ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। ইমন ভদ্রমহিলাকে নিজের পরিকল্পনাটি বলল। ভদ্রমহিলাও সম্মত হলেন। ইমন তাঁকে ফেসবুকে দিন-জায়গা-সময় মেসেজ করে দিল।
অতঃপর নির্ধারিত দিনে দুজনের সাক্ষাৎ হলো। ইমনের ভদ্রমহিলাকে খুব পরিচিত মনে হতে লাগল। সে সাহস করে ডাকল, ‘মা।’

ব্লক খেয়ে
মোবারক হোসেন
ছাত্ররাজনীতি করেন এমন একজন ক্যাডার-টাইপ বড় ভাইয়ের নাকি আজকাল মানসম্মান যায় যায় অবস্থা! তাঁর বন্ধুবান্ধব সবার ফেসবুক আছে; কিন্তু তাঁর কোনো ফেসবুক নেই। বড় দুঃখের বিষয়!
আমাকে জোর করে ধরলেন তাঁকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে হবে। তাঁকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে তাঁর রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে আমাকে কী কী সুবিধা দেবেন তার একটা তালিকা দিলেন। তালিকা দেখে আমার লোভ হলো। আমি আর না করতে পারিনি।
একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিলাম। আর তারপর থেকেই আমার ঘুম হারাম।
মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলেন, কই মোবারক, কেউ তো লাইক দেয় না!! তাজ্জব ব্যাপার-স্যাপার! নিজ দায়িত্বে ৫০-৬০ জন ফ্রেন্ড অ্যাড করে দিলাম; কিন্তু কেউ লাইক দেয় না। তা তো হতে পারে না।
‘ঠিক আছে ভাই, আমি দেখছি’ বলে লাইনটা কেটে দিয়ে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে ঢুকলাম। দেখি, কোনো পোস্ট নেই। ফোন দিলাম
: ‘ভাই, আপনার তো কোনো পোস্ট নাই। লাইক আসবে ক্যামনে?’
: ‘দুরো মিয়া, আমার পোস্ট নাই মানে? তুমি আমার পুস্ট জানো না? আমি ছাত্র...সম্পাদক...’
: ‘ভাই, এই পোস্ট সেই পোস্ট না।’
:‘তাহলে কোন পুস্ট?’
: ‘মানে লেখা, আপনার কিছু লেখা নাই।’
: ও ল্যাখা? তো ল্যাখা কইবা মিয়া!! পুস্ট কও ক্যান?’
:‘জি ভাই, ল্যাখা।’
তিনি লিখলেন ‘ame ...(অমুক রাজনৈতিক দলের তমুক) sampadak, amaka lyk daw’
এবারও কেউ লাইক দেয় নাই। ফোন পাইলাম আমি—
: ‘কী মিয়া, কেউ তো লাইক দেয় না।’
: ‘ভাই, দিব আস্তে আস্তে।’
: ‘আস্তে আস্তে মানে? তোমার তো দেখি ল্যাখা দেওয়া মাত্রই লাইক শুরু হয়ে যায়।’
: ‘ভাই, আমার বন্ধু বেশি।’
: ‘তো আমারেও বেশি বন্ধু বানাইয়া দাও।’
: ‘ভাই, এগুলো রিকোয়েস্ট পাঠাইতে হয়।’
কেমন করে রিকো পাঠাতে হয় তাঁকে বুঝিয়ে দিলাম। তারপর তিনি সারা দিন আনলিমিটেড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফেবু থেকে ব্লক খেয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।

একগুচ্ছ কদম
সাদিয়া তাসমিয়া
বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা শাহেদের জীবনের একমাত্র অবসর হচ্ছে সপ্তাহের এই এক শুক্রবার। তাই সাধারণত এ দিনটায় তিনি খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে সারা দিনে তাঁর বেডরুম ছাড়েন না। কিন্তু আজ ছাড়তে হবেই, না চাইলেও ফেসবুকে পরিচিত মিলি নামের অচেনা মেয়েটার প্রতি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। মিলি মেয়েটা অন্য রকম। আর দশটা মেয়ের মতো ছবি আপলোড করে না। বাসা থেকে তেমন একটা বের হয় না। তবে অনেক বেশি অনুরোধ করায় সে এই প্রথম শাহেদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে। শাহেদ ভেবেছেন মেয়েটাকে আজ সত্য বলেই দেবেন যে তিনি বিবাহিত; কিন্তু মিলির প্রতি দুর্বল।
শাহেদ আর নীলিমার দুই বছরের সংসার। পারিবারিকভাবে কদিনের পরিচয়ে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় শাহেদ কখনোই নীলিমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি। তাঁর সব সময় মনে হতো কী যেন একটা নেই। নীলিমা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে; কিন্তু শেষে যখন বুঝেছে যে শাহেদের তার প্রতি কোনো টানই নেই, তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
নীলিমা জানে যে আজকে শাহেদের এক ক্লায়েন্টের ছেলের জন্মদিনে যাবে। তার কিছুটা সন্দেহ হলেও সে কিছু বলল না। কারণ সেও আজ নিলয়ের সঙ্গে দেখা করবে। নিলয়ের সঙ্গে নীলিমার পরিচয়ও ফেসবুকে। নিলয়কে খুব পছন্দ করলেও সে জানে যে সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য তাকে কষ্ট করে হলেও শাহেদের সঙ্গে একই ছাদের নিচেই থাকতে হবে। সে আজকে নিলয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে শুধু বলতে যে তাদের মাঝে কিছু সম্ভব নয়।
ঠিক ১০টার সময় শাহেদ হাতে একগুচ্ছ কদম নিয়ে জায়গামতো পৌঁছে গেল। কদম মিলির খুব পছন্দ। ওই তো মিলি বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আছে। শাহেদ দৌড়ে তার সামনে গেল।
-‘নীলিমা, তুমি! এখানে কী করো?’
-‘তোমার না কার জন্মদিনে যাওয়ার কথা ছিল!’
-‘নীলিমা, তুমিই কি মিলি?’
-‘সে কথা রাখো। তুমিই কি নিলয়?’
শাহেদের চোখে পানি চলে এল। আজ সে বুঝেছে এত দিন তাঁদের মাঝে কমতি ছিল শুধু সময়ের। অপ্রস্তুতভাবে কদমগুচ্ছটা নীলিমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘তুমি কদমফুল পছন্দ করো? কখনো বলোনি তো!’
-‘কখনো জানতে চেয়েছ?’

জীবন বাঁচায়
লাতিন ইসরাক
রাত তিনটা...
মায়ের চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে উঠল রাকিব। ঘুম থেকে উঠতেই তার মা বলছেন, ‘তোর বাবা খুব অসুস্থ, দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাক।’ বলেই চলে গেলেন রাকিবের মা। মায়ের কথামতো দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল করে সেও চলে গেল বাবার রুমে। গিয়ে দেখে তার বাবা খুব অসুস্থ, দেখেই আর নিজেকে সামলাতে পারল না রাকিব। সে প্রহর গুনছে অ্যাম্বুলেন্সের, মিনিট পনেরো বাদেই চলে এল অ্যাম্বুলেন্স। নিয়ে গেল তার বাবাকে। ভর্তি করা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখলেন এবং জানালেন, দুই ঘণ্টার মধ্যেই রক্ত লাগবে। কথাটা শুনেই কেঁদে উঠলেন রাকিবের মা। কেননা তাঁর বাবার রক্ত যে এ নেগেটিভ (A-)। সঙ্গে সঙ্গে নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো, কিন্তু পাওয়া গেল না কাঙ্ক্ষিত রক্ত! তখনই রাকিবের মনে পড়ল ফেসবুকের কথা, সে মাঝে মাঝেই দেখে ফেসবুকে কিছু বড় বড় পেজে রক্তের সন্ধান করে পোস্ট করা হয়, যার ফলে দ্রুত রক্ত সংগ্রহ হয়ে যায়। বসে না থেকে দ্রুত সে ফেসবুকে পোস্ট করল। সেই লেখাটা বড় বড় পেজের কিংবা গ্রুপে দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার শেয়ার হয়ে গেল সেটি।
মাত্র ১৫ মিনিট পরেই সন্ধান মিলল রক্তের, যিনি রক্ত দেবেন তিনি কাছাকাছিই থাকেন। তাই সে যাত্রায় বেঁচে যান রাকিবের বাবা। ফেসবুক আমাদের জন্য বেশ উপকারী, যদি এটির সঠিক ব্যবহার হয়।

ভালো দিকটাই
ফারহানা আফরোজ
বর্তমান যুগে আমাদের চাওয়াগুলো যে হারে বাড়ছে, প্রাপ্তির সময় ততই কমছে। মানুষের সময় কই এত? ফলে আমরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। আগে যেখানে আমরা তিন ঘণ্টার বাংলা সিনেমা দেখার জন্য অধীর আগ্রহী হয়ে থাকতাম, সেই আমরা এখন কিনা শর্টফিল্ম বা নাটক দেখি পার্ট বাই পার্ট। আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া দূরে থাক; তাদের খোঁজ নেওয়ার সময়ও থাকে না। সেই হিসেবে আমরা হয়তো ফেসবুকের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই স্কুলে যে বন্ধুর পেনসিল ভেঙেছিলাম বলে রাগ করে আর কথাই বলেনি; সেই বন্ধুর সঙ্গে রাতভর কথা হলো ফেসবুকের কল্যাণে। এক মামার রক্তের জোগাড় হয়েছিল নিমেষেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে। কলেজ লাইফে সারা দিন গুনগুনিয়ে যে মুন্নি আপুর গান গাইতাম, তাঁকেও আমার ভালো লাগার কথা জানানোর জন্য তাঁর বাসার সামনে যেতে হয়নি, এই ফেসবুকেই জানিয়েছিলাম। আর শপিং? তা-ও কিন্তু এই ফেসবুকেই করতে পারি।
এসবের মাঝেও যে বিড়ম্বনা বা বিভ্রান্তিতে পড়ি না; তা কিন্তু নয়। আব্বুকে নিয়ে একটি পেজে কিছু পোস্ট দেখছি; এই সময় হুট করেই দেখলাম উল্টো-পাল্টা একটা লিংকের পোস্ট। কেমন লাগে বলেন? একটা ছবি দিলাম, সেখানে আবার বাজে কমেন্ট করেছে কেউ।


ফেসবুক পাঠ
ওমর ফারুক
পাঠদানের আগে ফেসবুক পাঠ, না শেখালে শিখবে কী করে। তাই ফেসবুক সচেতনতাই স্টুডেন্টদের কাছে আমার প্রথম পাঠ। ছাত্রী জেবিন সেদিন মরতে বসেছিল, তাও আবার সামান্য ফেসবুক অ্যাকাউন্টের জন্য। হ্যাঁ, গত ২ বছর ফেসবুক ব্যবহার করছে। বন্ধু, আড্ডা, শেয়ারিং প্রতিমুহূর্তের সব খবর ফেসবুকে দিতেই হবে। সেদিন জাফরের মোবাইল থেকে ফেসবুক ব্রাউজ করেছিল জেবিন। লগ আউট করেছিল ঠিকই; কিন্তু হিস্ট্রি থেকে গিয়েছিল। অতটা আর ভাবেইনি। প্রিয় বন্ধু বটে। অল্প বয়স দুষ্টুমির ছলেই জাফর অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে জেবিনের আইডিতে। তারপর যা হওয়ার। দুদিনে জাফর নিজের অজান্তেই জেবিনের জীবনে এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের সূচনা করে দিল। অথচ জেবিন একবারও ভাবেনি জাফর এসব করেছে। জেবিনের পরিবার ও জেবিনের যখন লজ্জায় ও চিন্তায় মাথা হেঁট, তখন জেবিন কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ল।