গাজীপুরের কোনাবাড়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) নিবাসীদের মধ্যে ৪১ শতাংশই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা কিশোরী

রাজধানী ঢাকার কলেজপড়ুয়া মেয়েটির (১৭) পাঁচ বছর ধরে সম্পর্ক ছিল পাশের ফ্ল্যাটের ভিন্ন ধর্মের এক ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি একটি সুপারশপের কর্মী। মেয়ের বাবা-মা ঘটনাটি জানতে পেরে মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ করে দেন এবং বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। গত ২৩ জানুয়ারি মেয়েটি ওই ছেলের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালায়। বন্ধু ও স্বজনের বাসায় দু–তিন দফা আশ্রয় নিয়ে তারা চলে যায় সাভারের আশুলিয়ায়। ৪ মার্চ বিয়ে করে তারা। জমানো টাকা দ্রুত শেষ হয়ে গেলে একপর্যায়ে দুজনই অসহায় হয়ে পড়ে। ২৩ মার্চ থানায় আত্মসমর্পণ করে। ছেলেটির বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা হওয়ার পর ২৭ মার্চ আদালতের মাধ্যমে মেয়েটিকে পাঠানো হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা)।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, কেন্দ্রের নিবাসীদের মধ্যে ৪১ শতাংশই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা কিশোরী। অভিভাবকের করা অপহরণের মামলায় তাদের সঙ্গীরা আসামি। সঙ্গীদের কেউ কারাগারে, কেউ জামিনে মুক্ত।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক কে এম ওবায়দুল্লাহ্ আল মাসুদ বলেন, সাধারণত অপহরণের মামলা হয় মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে। মামলায় আদালত ছেলেকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং মেয়ের কাছে জানতে চান সে কোথায় যেতে চায়। যেহেতু মা–বাবার অমতে বিয়ে, তাই মেয়েরা নিজের পরিবারে ফিরতে অসম্মতি জানায়। আবার অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাকে নিজের জিম্মাতেও ছেড়ে দিতে পারেন না আদালত। এ অবস্থায় মেয়েকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম বয়সে আবেগের বশে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা ভুল করে। সেই ভুলের মাশুল দিতে হয় মেয়েদের। অনেক মেয়ের পড়াশোনা আর এগোয় না। কম বয়সে মা হয়ে যায়। স্বাবলম্বী হওয়ার যে সম্ভাবনা তাদের মধ্যে ছিল, তা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়।
৪১ শতাংশ পালিয়ে বিয়ে
৮ আগস্ট সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) ১৫০ আসনের মধ্য এখন শিশু নিবাসীর সংখ্যা ৯৮। এর মধ্যে ভিকটিম ৫৪ জন। অর্থাৎ মামলায় তারা আসামি নয়, ঘটনার ভুক্তভোগী। এর মধ্যে ৪০ জন মা–বাবার অমতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে এবং তাদের সঙ্গীর বিরুদ্ধে অভিভাবক অপহরণের মামলা দিয়েছেন। বাকি ১৪ জন মানব পাচার, ধর্ষণের মতো বিভিন্ন মামলার ভুক্তভোগী। কোনো অভিভাবক না থাকায় তাদের কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এর বাইরে তিনজন ভুক্তভোগী মায়ের সঙ্গে তিন নবজাতকও রয়েছে।
অন্য নিবাসীদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, ২ জনের বিরুদ্ধে মাদক, ৫ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু পাচার, একজনের বিরুদ্ধে মানব পাচার এবং তিনজনের বিরুদ্ধে চুরির মামলা রয়েছে। নিরাপদ হেফাজতে রয়েছে ১২ জন, এদের সঙ্গে মামলার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অভিভাবকহীন এই শিশুদের মূলত শিশু পরিবারের মতো সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানে থাকার কথা। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে কেন্দ্রে রয়েছে আরও ১০ জন। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব-১৮ বছরের মেয়েশিশু আইনের সংস্পর্শে এলে তাদের কেন্দ্রে রাখা হয়।
৯৫ শতাংশই শিক্ষার্থী
প্রতিবেশী এক ছেলের সঙ্গে দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল স্কুলপড়ুয়া ১৫ বছরের এক কিশোরীর। গত ১ এপ্রিল কিশোরী তাদের নোয়াখালীর বাসা থেকে ছেলেটির সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। পরে তারা ময়মনসিংহ চলে যায়। দেড় মাস পর মেয়েটি তার মাকে ফোন করে বিয়ের কথা জানায়। পরদিনই স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করে মেয়েটির পরিবার। অপহরণের মামলার আসামি হিসেবে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে হাজির করা হলে আদালত ছেলেটিকে গাজীপুর কারাগারে এবং মেয়েটিকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক কে এম ওবায়দুল্লাহ্ আল মাসুদ জানান, অভিভাবকের অমতে বিয়ে করা কিশোরীদের ৯৫ শতাংশই ছাত্রী। প্রতিবেশী, খালাতো-মামাতো ভাই, শিক্ষক ইত্যাদি সম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থেকে তারা আইনি জটিলতায় পড়ে যায়। কেন্দ্রে এখন এমন ৪০ জন নিবাসী রয়েছে, যারা অভিভাবকের অমতে বিয়ে করেছে। তিনি বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়। আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত না নিয়ে তারা যেন পড়াশোনা অব্যাহত রাখে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে সে বিষয়ে তাদের কাউন্সেলিং করা হয় কেন্দ্র থেকে।
বিপদ সম্পর্কে ধারণা নেই
২০১৯ ও ২০২০ সালে ছয়বার কোনাবাড়ীর কেন্দ্রটিতে গিয়ে নিবাসীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের (সমাজবিজ্ঞান) সহকারী অধ্যাপক সুহেলী সায়লা আহমদ। তিনি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নিবাসীদের মানসিক অবস্থা নিয়ে পিএইচডি করছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিবাসীদের মধ্যে ছয়টি মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যারা পালিয়ে বিয়ে করেছে। এর মধ্যে তিন কিশোরীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পেয়েছিলাম। ওই মেয়েরা বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানে না, আইন সম্পর্কে ধারণা নেই, অপরিপক্বতার কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলে কী কী ধরনের বিপদের মধ্যে পড়তে পারে, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই।। শুধু কম বয়সের আবেগ ও সাময়িক উত্তেজনা থেকে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। একধরনের ফ্যান্টাসির মধ্যে তাদের বসবাস।’
ওই মেয়েদের কারও ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি উদাসীনতা, কারও ক্ষেত্রে অতিশাসন ছিল বলে জানান সুহেলী সায়লা আহমদ। ফলে আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তারা ছেলে বন্ধুদের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে। তিনি বলেন, প্রেম তাদের কাছে একটি বড় বিনোদনের বিষয়। প্রেমিক প্রশংসা করে, গুরুত্ব দেয় এবং উপহার দেয়—এটা তাদের মধ্যে এতই ভালো লাগা সৃষ্টি করে যে কোনো চ্যালেঞ্জের বিষয় মাথায় রাখেনি।
সন্তানের বন্ধু হতে হবে
কম বয়সের অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে সন্তানকে বিরত রাখতে মা–বাবাকে সন্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে হবে বলে জোর দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, কিশোর বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আবেগের প্রবল্য থাকা। আবেগের সিদ্ধান্তে যুক্তি থাকে না বলে সিদ্ধান্তে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। আবেগের বশে পরিণতি না ভেবে কিশোরীরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মা–বাবার নেতিবাচক আচরণের কারণে। মেয়ে প্রেমে জড়িয়েছে জানামাত্র মা–বাবা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। মা–বাবার এ আচরণের কারণে মেয়েটির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয় এবং সম্পর্কটিতে আরও জড়িয়ে যায়।
এ অবস্থায় মা–বাবাকে কৌশলী হতে হবে। ছেলেটি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করে মেয়েটিকে পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। মেয়েটিকে বলতে হবে, ‘তোমার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা একমত নই। তবে তুমি আগে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। এরপর তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ো কাকে বিয়ে করবে। এমন পরামর্শ মেখলা সরকারের। পাশাপাশি মা–বাবাকে সতর্কতার সঙ্গে মেয়ের ওপর নজর রাখতে হবে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় যায় খেয়াল রাখতে হবে। পড়াশোনার অজুহাত দিয়ে মুঠোফোন ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তুলে মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।