
মেঘলা আকাশ। হু হু করে হাওয়া বইছে। আমার অফিসের বড় বড় দুটি কাচের জানালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে হাওয়ার দৈত্য। এপ্রিল-মে মাসে একবার এবং অক্টোবর-নভেম্বরে একবার আমেরিকায় এই আউলা বাতাস বয়। নভেম্বরের বাতাসে লাল-হলুদ রঙে সজ্জিত গাছের পাতা ঝরতে থাকে। আর এ জন্যই এ সময়টাকে বলা হয় ‘ফল’ বা ‘ঝরা’ ঋতু। উন্নত দেশের লোকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করে ফেলেছে অনেক আগেই। বৃষ্টি কিংবা তুষারপাত যাই হোক না কেন, কেউ কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকে না। আমিও এই হু হু শীতল হাওয়ার সমূহ অত্যাচারকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম। এখন ১২টা বাজে। সেকেন্ড অ্যাভিনিউর এপারে আমার অফিস ওপারে অলিম্পিয়া। খুব বেশি দূরে যাব না। অলিম্পিয়ার চিকেন স্যুপ দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ সেরে নেব আজ। ভাবতে ভাবতে লিফটে উঠেছি। এর মধ্যে হুড়মুড় করে একগাদা লোক লিফটে এসে উঠল। সবার হাতেই একটি করে ছাপানো কাগজ। ওরা কি কোনো মিছিলে যাচ্ছে? এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়? আমার সহকর্মী সিলভাইনকেও দেখতে পাচ্ছি এ দলে। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতেই ও আমাকে প্রশ্ন করে, আপনি জানেন না? আমি বলি, কী? ‘কোসি’ আজ ফ্রি লাঞ্চ দিচ্ছে। আজই শেষ দিন। এর আগের দুই শুক্রবারও দিয়েছে। আপনার কাগজ কই? নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। কোসি নামের দোকানে ফ্রি লাঞ্চ খাওয়াচ্ছে, সবাই জানে, আর আমি জানি না? আমি বলি, আমি কার্বোহাইড্রেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি তো তাই যাব না। তা ছাড়া নিশ্চয়ই অনেক লম্বা লাইন হবে। তা হবে, বলেই ওরা লিফট থেকে নেমে পড়ল। আমিও অলিম্পিয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করি।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই ফ্রি খাবার ও পানীয় পাওয়া যায়। বড় বড় সুপার মার্কেটগুলোতে সব সময়ই যাচাই করার জন্য খদ্দেরদের নানান রকম খাবার পরিবেশন করা হয়। টুথপিকের ডগায় লাগানো মুরগি বা চিজের টুকরো আমরা কে না খেয়েছি। ফলের রস, ইওগার্ট থেকে শুরু করে চিপস, রুটি, নানান রকম ফলের টুকরো, গ্রিল করা মাছ বা মাংসের টুকরো, আরও কত কী যে বিনে পয়সায় পরিবেশন করে। কেউ চাইলে ছুটির দিনে কোনো একটি বড় সুপার মার্কেটে ঢুকে এসব নমুনা খাবার খেয়েই লাঞ্চ বা ডিনার সেরে ফেলতে পারে। এ তো গেল ফ্রি নমুনা খাবার। মাঝেমধ্যে অফিসে আসার পথে দেখি কোনো এক কফি শপের সামনে একটি কাগজ লাগানো, ‘আজ সারা দিন ফ্রি কফি’। কোনো কোনো রেস্টুরেন্ট সপ্তাহের কোনো এক দিন পরিবেশন করে বিনে পয়সার খাবার। ফ্রি সেবাও পাওয়া যায়, যেমন প্রায়ই দেখি হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছে, ৩০ মিনিট ফ্রি বডি ম্যাসাজ। কখনো কখনো দেখা যায় কোনো অ্যাটর্নির লিফলেট, প্রথম ভিজিট ফ্রি। অথচ এমনিতে সেই অ্যাটর্নির দেখা পেতে গুনতে হয় ঘণ্টায় ৪০০ ডলার।
স্যুপ নিয়ে অফিসে ফিরে এলাম বটে কিন্তু আমার বাঙালি মস্তিষ্ক উসখুস করছে। একটি কথা আছে না, ‘বাঙালি ফ্রি পেলে নতুন জামায় আলকাতরা মাখে।’ গত সপ্তাহে ডাক্তার আমাকে ওজন কমাতে বলেছে। কোসির ফ্রি লাঞ্চটি নিঃসন্দেহে আমার জন্য এখন ফ্রি আলকাতরার চেয়ে উন্নত কিছু নয়। কোনো রকমে নিজেকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করলাম। অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরব। রুমের তালা লাগাতে লাগাতে দেখি আমার আরেক সহকর্মী সিমি, দুপুরে সিলভাইনের হাতে দেখা, ফ্রি লাঞ্চের কুপনটি নিয়ে ধাঁ ধাঁ করে ছুটে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম। সিমি মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য ঘুরে বলল, দেরি করিয়ে দেবেন না, কোসি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে এল শ্রীলঙ্কান সহকর্মী মিরাকুলা, হাতে সেই একই কাগজ। ও আমাকে পাশ কাটাতে কাটাতে বলল, আমি এক কপি বেশি প্রিন্ট করেছি, আপনার চাই একটা? আমি বললাম, অবশ্যই। এরপর ওদের পেছন পেছন আমিও দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করি।
কাজী জহিরুল ইসলাম
নিউইয়র্ক থেকে